প্রি-ডায়াবেটিস সম্পর্কে কতটা জানি ?

ডায়াবেটিস শব্দটির সাথে আমরা কম বেশি সবাই পরিচিত। কিন্তু প্রি-ডায়াবেটিস সম্পর্কে আমাদের তেমন কোন ধারণা নেই। প্রি-ডায়াবেটিস আছে এমন ব্যক্তিদের পরবর্তী ৮ বছরের মধ্যে ডায়াবেটিস হওয়ার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি থাকে। প্রি-ডায়াবেটিস হলো এমন একটি শারীরিক অবস্থা যেখানে রক্তে সুগারের পরিমাণ অনেক বেশি বেড়ে যায়। তবে, এটি ডায়াবেটিসের তুলনায় কম হওয়ায় একে ডায়াবেটিসও বলা যায় না।
প্রি-ডায়াবেটিসের সময় সতর্ক থাকলে ডায়াবেটিস থেকেও সহজেই দূরে থাকা যায়। ডায়াবেটিসের চেয়েও মারাত্মক হতে পারে প্রি-ডায়াবেটিস। ডায়াবেটিস হওয়ার আগেই প্রিডায়াবেটিসের সম্মুখীন হতে হয়। ডায়াবেটিসের এটি একটি প্রাথমিক অবস্থা।
প্রাথমিক অবস্থায় শরীরে শর্করার মাত্রা বেড়ে যাওয়ার ফলে বিভিন্ন লক্ষণ প্রকাশ পায়। যেমন-
- ঘন ঘন প্রস্রাব
- উচ্চ রক্তচাপ
- ক্লান্তিবোধ
- ওজন বেড়ে যাওয়া
- পিপাসা
- ক্ষুধার পরিমাণ বেড়ে যাওয়া
- উচ্চ কোলেস্টেরল
- নারীর পিসিওডি থাকলে অনিয়মিত পিরিয়ড
ডায়াবেটিসের সংকেত বলা হয় এসব লক্ষণকে। হয়তো প্রাথমিকভাবে এসব লক্ষণ লক্ষ্য করা যায় না। ডায়াবেটিসের চেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ বলে মনে করা হয় প্রি-ডায়াবেটিসের সময়কালকে।
যদি HbA1c টেস্টে সুগারের পরিমাণ ৪-৫.৭ এর মধ্যে হয় তবে এটি স্বাভাবিক। যদি ৫.৭-৬.৪ হয় তবে এটি প্রি- ডায়াবেটিস হিসাবে গণ্য করা হয়। যদি কারো প্রি-ডায়াবেটিস থাকে তবে ১০ বছরের মধ্যে টাইপ- ২ ডায়াবেটিস হওয়ার ঝুঁকি অতিরিক্ত মাত্রায় থাকে।
প্রি-ডায়াবেটিস হল রক্তে শর্করার মাত্রা যতটা হওয়া উচিত তার চেয়ে বেশি তবে ডাক্তারের পক্ষে ডায়াবেটিস নির্ধারণের পক্ষে পর্যাপ্ত পরিমাণে শর্করার মাত্রা প্রকাশ পায় না। এটিকে অনাহারী রোজার গ্লুকোজ বা প্রতিবন্ধী গ্লুকোজ সহনশীলতাও বলা হয়ে থাকে।
টাইপ ২ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ব্যক্তিদের প্রায় সবসময় প্রি-ডায়াবেটিস থাকে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ২০ বছরেরও বেশি বয়সের প্রায় ৮৪ মিলিয়ন লোকের প্রি-ডায়াবেটিস রয়েছে। তবে ৯০% জানেন না যে তাদের প্রি-ডায়াবেটিস রয়েছে। প্রি-ডায়াবেটিসের প্রধান কারণ হল ইনসুলিনের অপর্যাপ্ত উৎপাদন।
ইনসুলিন হল অগ্ন্যাশয় দ্বারা তৈরি হরমোন যা রক্তের শর্করাকে শক্তি হিসাবে ব্যবহারের জন্য রক্ত শর্করায় প্রবেশ করতে সাহায্য করে এমন একটি উপাদান । যদি প্রি-ডায়াবেটিস হয় তবে দেহের কোষগুলি ইনসুলিনের জন্য সাধারণত প্রতিক্রিয়া জানায় না। অগ্ন্যাশয় কোষগুলো
প্রতিক্রিয়া জানাতে চেষ্টা করার জন্য আরও ইনসুলিন তৈরি করে এবং অগ্ন্যাশয় ধরে রাখতে পারে না। রক্তে শর্করার পরিমাণ বেড়ে যায় প্রি-ডায়াবেটিসের জন্য ঝুঁকি বাড়ায় ও টাইপ ২ ডায়াবেটিসের দিকে ক্রমাগত অগ্রসর হয়। বছরের পর বছর ধরে প্রি- ডায়াবেটিস হতে পারে তবে কোন সুস্পষ্ট লক্ষণ প্রকাশ না করেই। তাই টাইপ ২ ডায়াবেটিসের মতো গুরুতর স্বাস্থ্য সমস্যা না হওয়া পর্যন্ত এটি শনাক্ত করা সম্ভব হয় না।
কিছু লক্ষণের মাধ্যমে প্রি-ডায়াবেটিস প্রকাশ পায়। যেমন-
- -অতিরিক্ত পিপাসা
- -ঘন ঘন প্রস্রাব।
- -দৃষ্টি ঝাপসা
- -দুর্বলতা
যাদের প্রি- ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বেশি রয়েছে-
- -বয়স্ক মানুষ। বিশেষ করে যাদের বয়স ৪৫ বছরের বেশি।
- – অতিরিক্ত ওজন
- – খাদ্যভ্যাস
- -আফ্রিকান, আমেরিকান, নেটিভ আমেরিকান, ল্যাটিনো বা প্যাসিফিক আইল্যান্ডার
- -অতিরিক্ত ওজনযুক্ত বা অতিরিক্ত পেটের ফ্যাট
- -উচ্চ কোলেস্টেরল, উচ্চ ট্রাইগ্লিসারাইড
- -যারা হাঁটা চলা কম করে।
- -গর্ভকালীন ডায়াবেটিস যাদের ছিল বা এমন একটি শিশু যিনি জন্ম দিয়েছে যার ওজন ৯ পাউন্ডেরও বেশি ছিল
- -পলিসিস্টিক ডিম্বাশয় সিন্ড্রোম যাদের আছে।
- -ঘুমের সমস্যা
- -হৃদরোগ যাদের আছে।
অনেকেই পারিবারিক বা বংশগতভাবে টাইপ-২ ডায়াবেটিস রয়েছে
প্রি-ডায়াবেটিসের ক্ষেত্রেও বংশগত অনেক কারণ রয়েছে। যদি পরিবারের কারও কাছে টাইপ ২ ডায়াবেটিস ইতিহাস থাকে তবে পরবর্তী বংশধরের প্রি-ডায়াবেটিস এবং টাইপ ২ ডায়াবেটিস হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
জাতি এবং জাতিসত্তাও প্রি-ডায়াবেটিস হওয়ার সম্ভাবনা প্রভাবিত করে। একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে ডায়াবেটিসের বিকাশ ঘটে বর্ণগত বৈষম্যের কারণে এবং জিনের তুলনায় সম্প্রদায়ের আর্থ-সামাজিক অবস্থান এবং স্বাস্থ্যসেবা ও স্বাস্থ্যকর খাবারের প্রাধান্য বেশি রয়েছে।
আমাদের আশেপাশে অনেকের সিগারেটে খাওয়ার অভ্যাস রয়েছে। নিকোটিন কোষের ইনসুলিনের সংবেদনশীলতা হ্রাস করে যা রক্তে গ্লুকোজ বাড়ায়। সিগারেটের অন্যান্য রাসায়নিক উপাদানগুলো প্রদাহ সৃষ্টি করে এবং সেই কোষগুলির জন্য ইনসুলিন গ্রহণ করা আরও কঠিন হয়ে যায়। প্রি- ডায়াবেটিসের তেমন কোনও জটিলতা নেই। তবে যদি এটি পরীক্ষা করা না হয় তবে এটি টাইপ ২ ডায়াবেটিসে পরিণত হতে পারে। যা মারাত্মক জটিলতা আনতে পারে।
টাইপ ২ ডায়াবেটিসের কিছু জটিলতা রয়েছে। যেমন-
- -উচ্চ রক্তচাপ
- – হৃদরোগ
- -কিডনির ক্ষতি
- -চোখের সমস্যা
- -নিউরোপ্যাথি
- -ত্বকের সংক্রমণ বা এলার্জি
- -নিদ্রাহীনতা
- -ডায়াবেটিস ফুসকুড়ি
ব্যায়াম হল প্রি-ডায়াবেটিসকে দূর করার দুর্দান্ত উপায়। যখন কেউ ব্যায়াম করে তখন দেহ আরও বেশি গ্লুকোজ ব্যবহার করে যা রক্ত প্রবাহের বাইরে পরিষ্কার করতে সহায়তা করে।
অনুশীলন বা ব্যায়ামের ফলে GLUT-4 নামক একটি কোষের রিসেপটরকে সক্রিয় থাকে। যা রক্ত প্রবাহের বাইরে গ্লুকোজ শুষে নিতে এবং এটি কোষে স্থানান্তরিত করতে সহায়তা করে। শারীরিক ব্যায়াম GLUT-4 প্রক্রিয়া সক্রিয় করতে সহায়তা করে।
আমেরিকান ডায়াবেটিস অ্যাসোসিয়েশন প্রতি সপ্তাহে কমপক্ষে ১৫০ মিনিট মাঝারি শারীরিক ক্রিয়াকলাপের প্রস্তাব দেয়। যা সাধারণত গড়ে ৩০ মিনিট ও সপ্তাহে ৫ বারের মতো হয়।
অতিরিক্ত ওজন ও ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়ায়। দেহের ওজনের মাত্র ৫-১০% হ্রাস করে টাইপ 2 ডায়াবেটিস হওয়ার ঝুঁকি এড়ানো সম্ভব।
অতিরিক্ত ওষুধ সেবন বা ওষুধের প্বার্শপ্রতিক্রিয়া হিসেবে অনেক সময় মানুষ দুর্বল বা ডায়াবেটিসের দিকে অগ্রসর হয়।
প্রি- ডায়াবেটিস চিকিৎসার জন্য ওষুধ খাওয়ানো বা কাটা ছিঁড়া করা হয় না। রক্তে শর্করার মাত্রা HbA1c টেস্ট বা চিকিৎসার ইতিহাস এবং অন্যান্য জটিলতাগুলি এমন পরিস্থিতিতে ফেলতে পারে যেখানে টাইপ ২ এড়ানোর জন্য চিকিৎসার পরিকল্পনায় ওষুধ যুক্ত করা হতে পারে।
প্রি-ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ব্যাক্তির প্রচুর পরিমাণে চিনি বা কার্বোহাইড্রেট খাওয়া উচিত নয়। পরিবর্তে পুরো শস্য, ফলমূল এবং মাড়যুক্ত শাকসবজি (পরিমিতভাবে) থেকে শর্করা গ্রহণ করা উচিত। প্রতিদিন খাবার থেকে ২৫-৩০ গ্রাম ফাইবারের জন্য খাদ্য গ্রহণ করা উচিত। কারণ ওটমিল এবং ক্রাঞ্চযুক্ত শাকসবজির মতো ফাইবার সমৃদ্ধ খাবারগুলি ইনসুলিন প্রতিরোধের উন্নতি করে এবং আরও দীর্ঘতর রাখতে সাহায্য করে।
এটি ডায়াবেটিসের পাশাপাশি এটি হৃদরোগের ঝুঁকিও অত্যন্ত বাড়িয়ে দেয়। এটি প্রতিরোধে
- -স্বাস্থ্যকর খাবার গ্রহণ করা উচিত। যেমন – শস্যকণা, নিম্ন চর্বিযুক্ত দুগ্ধজাত পণ্য,শাকসবজি ও ফল-মূল ইত্যাদি।
- -ওজন কমানো বা,সামান্য ওজন হারানো স্বাস্থ্যের একটা বৃহৎ পার্থক্য তৈরি করতে পারে।
- – নিয়মিত ব্যায়াম করা
- -মিষ্টিজাতীয় খাবার পরিহার করা
- -নিম্ন ফ্যাটযুক্ত প্রোটিন গ্রহণ
- – উচ্চ আঁশজাতীয় খাবার খেতে হবে।
- – ক্যালোরি সীমিত করতে হবে।
- -উচ্চ রক্তচাপের চিকিৎসা নিতে হবে।
- – উচ্চ কোলেস্টেরোল কমাতে হবে।
- -ধুমপান পরিহার করতে হবে।
ইনসুলিন হরমোন যখন শরীরে ভারসাম্যহীন থাকে বা গ্লুকোজ স্তর রক্তে শর্করার মাত্রা বাড়িয়ে তোলে তখন তা ডায়াবেটিসের কারণ হয়ে দাড়াঁয়। অনিয়মিত জীবন যাপন ও শরীরচর্চার অভাবে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়।
আফিয়া ইমরাদ তাহাসিন
বায়োকেমিস্ট্রি এন্ড বায়োটেকনোলজি ডিপার্টমেন্ট
ইউনিভার্সিটি অফ সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি চিটাগং
তথ্যসূত্র –