ঔষুধি গাছ পরিচিতি এবং এদের যত ব্যবহার

যেসব গাছের বিভিন্ন অংশের ঔষুধি উপাদান আছে এবং এসব উপাদান মানুষ এবং অন্যান্য প্রাণীদেহের রোগ বালাই প্রতিরোধ বা প্রতিকার করার ক্ষমতা নিয়ে প্রাচীনকাল থেকে শুরু করে বর্তমানে আধুনিক চিকিৎসা কাজেও ব্যাবহৃত হয়ে আসছে তাদেরকেই আমরা বলি ঔষুধি গাছ বা Medicinal Plant. আমাদের বেঁচে থাকার লড়াইয়ে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে এসব ঔষুধি গাছের অবদান।ঔষুধি গাছ গুলো সাধারণ গাছ থেকে কিছুটা আলাদা বৈশিষ্ট্য ধারণ করে মূলত তাদের মধ্যে থাকা বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থ,ভিটামিন,গ্লাইকোসাইড,ট্যানিন কিংবা উদ্বায়ী পদার্থ, ইত্যাদির উপস্থিতির কারণে।
প্রাচীনকাল থেকেই ঔষুধি গাছ ব্যবহারের প্রচলন থাকলেও আধুনিক চিকিৎসায়ও পাল্লা দিয়ে বাড়ছে নানান ধরনের ঔষুধি গাছের সুষ্ঠু প্রয়োগ।কিডনি,লিভার,হৃদরোগ,ফুসফুসজনিত রোগসহ বর্তমানে প্রায় সব ধরনের জটিল রোগের চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়ে আসছে ঔষুধি গাছ থেকে প্রাপ্ত উপাদানসমূহ। অন্যদিকে, নতুন ঔষুধ সন্ধানের লক্ষ্যে Drug Development প্রক্রিয়াতে নানা ধরনের জানা – অজানা ঔষুধি গাছের উপাদান সংশ্লেষনের মাধ্যমে প্রতিনিয়ত চলছে গবেষণা। ধ্বংস ও বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষার জন্য এবং যথাযথ যত্ন নেয়ার জন্য ঔষুধি গাছ সম্বন্ধে আমাদের পর্যাপ্ত জ্ঞান থাকা প্রয়োজন। ঔষুধি গাছের যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ করলে এদের রপ্তানি করে আমরা লাভজনক হতে পারি। কারণ বর্তমান বিশ্বে গবেষণা থেকে শুরু করে ঔষুধশিল্প সর্বোপরি বিস্তৃত ঔষুধি গাছের প্রয়োজনীয়তা।
Ocimum sanctum
প্রচলিত নাম তুলসী। তুলসী অর্থ যার তুলনা নেই। দক্ষিণ এশিয়ায় ঔষুধি গাছ হিসেবে এর ব্যাপক প্রচলন আছে।
তুলসী ২/৩ ফুট লম্বা একটি চিরহরিৎ গুল্ম। এর কান্ড মূলত কাষ্ঠল এবং পাতা ২-৪ ইঞ্চি লম্বা। পাতার কিনারা থাকে খাঁজকাটা। তুলসীর ফুল,ফল এবং পাতা থেকে ঝাঁঝালো গন্ধ পাওয়া যায়।
মধ্য আফ্রিকা থেকে দক্ষিণ – পূর্ব এশিয়ার গ্রীষ্মপ্রধান অঞ্চলে তুলসীর দেখা পাওয়া যায়। বাংলাদেশ ও ভারতের প্রায় সব জায়গায় বিস্তৃতি রয়েছে এ গাছের।
ঔষুধি গুণাগুন পাওয়ার জন্য সাধারণত এ গাছের পাতা, রস ও বীজ ব্যবহৃত হয়। সর্দি,কাশি,ঠান্ডা এসব দূরীকরণে তুলসী ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে যুগযুগ ধরে। এছাড়াও হেপাটাইসিস, পাকস্থলীর ক্যান্সার, দাঁতের ক্ষয়,দাঁতে ব্যথা,কানের সংক্রমণ ও ব্যথা,কোষ্ঠকাঠিন্য,বাত,হাঁপানি ইত্যাদি প্রতিরোধে তুলসী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তুলসী এবং গোলমরিচের মিশ্রণ ম্যালেরিয়া রোগের ভালো প্রতিষেধক হিসেবে কাজ করে।
Aloe indica
প্রচলিত নাম অ্যালোভেরা বা ঘৃতকুমারী। ভেষজ চিকিৎসায় বহুল ব্যবহৃত এ উদ্ভিদটি বাণিজ্যিকভাবে চাষ করা হয় এর উপকারিতা এবং চাহিদার কথা ভেবে। আজকাল মানুষ নিজেদের বাসায় টবে ও অ্যালোভেরা লাগাচ্ছে এর বিভিন্ন উপকারিতার কথা মাথায় রেখে।
অ্যালোভেরা দেখতে অনেকটা ক্যাকটাস বা ফনিমনসা গাছের মতো। পাতার দুপাশ ছোট কাটাঁযুক্ত। উপরের সবুজ,ভারী আস্তরণের ভিতরে রয়েছে সাদা, পিচ্ছিল ও আঠালো জেলির ন্যায় রসালো অংশ। এক একটি গাছ থেকে ৬০-৭০ টি পর্যন্ত পাতা পাওয়া যায়। অ্যালোভেরা গাছের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হল এর পাতা থেকে গাছ জন্মায়।
বাণিজ্যিকভাবে চাষ হওয়ার কারণে বর্তমানে পৃথিবীর প্রায় সর্বত্রই অ্যালোভেরার বিস্তার রয়েছে। আরব দেশগুলোতে এটি খুব বেশি দেখতে পাওয়া যায়। উত্তর আফ্রিকা,সুদান এবং দক্ষিণ ইউরোপে অ্যালোভেরার উপস্থিতি রয়েছে বহু আগে থেকেই।
মূলত অ্যালোভেরার জেলীর ন্যায় অংশটি ঔষুধি কাজে ব্যবহৃত হয়ে আসছে,যাকে বলা হয় অ্যালোভেরা জেল।হজম শক্তি বাড়ানো,পরিপাকতন্ত্রের কাজ ঠিক রাখা এবং কোষ্ঠকাঠিন্য দূরীকরণে অ্যালোভেরার ব্যবহার বেশ প্রচলিত। এছাড়াও অ্যালোভেরা ওজন ঠিক রাখতে, রোগ- প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে, শরীরকে চাপমুক্ত রাখতে,হাড় ও মাংসপেশির জোড়া শক্তিশালী করতে এবং শরীরের প্রদাহ কমাতে সহায়তা করে।
Centella asiatica
আঞ্চলিক ভাবে এটি টেয়া,মানকি,থানকুনি,তিতুরা ইত্যাদি নামে পরিচিত। তন্মধ্যে থানকুনি নামটিই বেশি পরিচিত। আয়ুর্বেদে থানকুনিকে ত্বাষ্ট্র বলা হয়।এটি সাধারণত গ্রামাঞ্চলে, বন-জঙ্গলে বেশি দেখা যায়। ঔষধি গুণের কথা বিবেচনা করে বর্তমানে অনেকে থানকুনি চাষ করে থাকে।
থানকুনি গাছের লতা মাটির ওপর বেয়ে বেড়ায়। পাতা সবুজ বর্ণের এবং গোলাকার পাতার কিনারা থাকে খাঁজকাটা।
বাংলাদেশ,ভারতসহ গ্রীষ্মমন্ডলীয় এবং আর্দ্র আবহাওয়ার প্রায় সব দেশে থানকুনি ভালো জন্মে।বাংলাদেশের প্রায় সর্বত্রই এর বিস্তার দেখা যায়। শিকড়সহ লতা এনে আর্দ্র মাটিতে রোপন করলেই থানকুনি জন্মে। তবে জলাবন্ধতায় থানকুনি বেঁচে থাকতে পারে না।
রক্তক্ষরণ বন্ধ করতে এবং ক্ষতস্থান সারিয়ে তুলতে থানকুনি বেশ কার্যকরী। থানকুনির মধ্যে থাকা স্পেয়োনিনস এবং অন্যান্য উপাদানের জন্য থানকুনির এ বিশেষ বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান। ‘Essential Oil’ এর উপস্থিতির জন্য থানকুনির রস আমাশয় বা বদহজমজনিত সমস্যা দূরীকরণে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। থানকুনির Bacoside A এবং Bacoside B আমাদের মস্তিষ্কের কোষ গঠনে সহায়তা করে,রংক্তসংবহন বাড়ায়। এগুলো ছাড়াও থানকুনি পাতার রস দাঁত ব্যথা, কাশি, চর্মরোগ ইত্যাদি প্রশমনে কাজ করে।
Mentha spearmint
প্রচলিত নাম পুদিনা। এ নামেই এটি বেশ পরিচিত। Mint, Mentha, Menthol plant হলো এর কিছু সাধারণ ইংরেজি নাম। আয়ুর্বেদিক শাস্ত্রে একে বলা হয় রোচনী।সুগন্ধি হিসেবে বিভিন্ন খাবার তৈরিতে ও ঔষুধ তৈরিতে এর বহুবিধ ব্যবহার থাকায় বাণিজ্যিকভাবে ও বাসাবাড়িতে পুদিনা চাষ হচ্ছে প্রচুর।
পুদিনা জাতভেদে ১০-৩০ ইঞ্চি লম্বা হয়। এটি বিস্তৃত ভূগর্ভস্থ রাইজোম এবং কান্ড ও শাখা- প্রশাখা বিশিষ্ট। পাতা সাধারণত গাঢ় সবুজ বর্ণের হয়, তবে কিছু ক্ষেত্রে ধূসর সবুজ বা ফ্যাকাশে হলুদ বর্ণের হয়ে থাকে। পাতার প্রান্তভাগ করাতের ন্যায় কাঁটাময় এবং পাতাগুলো জোড়ায় জোড়ায় পরস্পর বিপরীতে অবস্থান করে।
বাংলাদেশ,ভারত,ইউরোপ,আফ্রিকা ও অষ্ট্রেলিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে প্রায় ৬৫০ জাতের পুদিনার দেখা পাওয়া যায়। এদের বেশিরভাগ ই প্যারিনিয়েল এবং কিছু কিছু একবর্ষজীবী।
ঔষুধি গুণাগুণ থাকায় পুদিনার পাতা নানা ধরনের শারীরিক জটিলতা কমাতে বা নিরাময় করতে ব্যবহৃত হয়ে আসছে প্রাচীনকাল থেকেই। পুদিনা বদহজম কমাতে দারুণ উপকারী। সহজেই ফ্যাট ভেঙ্গে হজমে সহায়তা করে এবং মেদ কমাতে সহায়তা করে। পিত্তরসের প্রবাহ নিয়ন্ত্রণে রাখে ও পিত্ত পাথর তৈরিতে বাধাপ্রদান করে। পুদিনার আরেকটি বিশেষ গুণ হলো, এর মধ্যে থাকা মেন্থল মিউকাসকে পাতলা করে কফ প্রশমনে সাহায্য করে। এগুলো ছাড়াও পাকস্থলীর প্রদাহ,বুক ব্যথা, চর্মরোগ,ক্ষুধামন্দা ইত্যাদি দূরীকরণে এবং শরীরকে সতেজ রাখতে পুদিনার জুড়ি নেই।
Azadirachta indica
প্রচলিত নাম নিম। এটি Meliaceae পরিবারের অন্তর্ভুক্ত চিরহরিৎ বৃক্ষ। জনপ্রিয় এ ঔষুধি গাছটি নিম্ব,ভেপা,তামার ইত্যাদি নামেও সুপরিচিত। এর প্রাকৃতিক ঔষধি গুণাবলির জন্য যুগ যুগ ধরে নানা ধরণের রোগের চিকিৎসা কাজে ব্যবহৃত হয়ে আসছে।
দ্রুতবর্ধনশীল এ ঔষুধি গাছটি পরিণত বয়সে ১৫-২০ মিটার লম্বা হয়ে থাকে। গোড়ার ব্যাসার্ধ প্রায় ৬০-৭০ সেমি। পাতা গাঢ় সবুজ বর্ণের হয়ে থাকে এবং প্রতিটি পাতায় ১০-১৭ টি খাঁজকাটা কিনারাবিশিষ্ট পত্রক থাকে। সারাবছর নিমগাছের পাতা গজালেও বসন্তে অধিকাংশ পাতা ঝরে যায়।
বাংলাদেশ,ভারত এবং মায়ানমার কে বলা হয় নিমের আদি উৎপত্তিস্থল।এছাড়া পাকিস্তান ও সৌদি আরবে ও নিম গাছ জন্মে। তবে উষ্ণ ও আর্দ্র অঞ্চলে নিম গাছ ভালো জন্মে। বাংলাদেশের সর্বত্র এর বিস্তার থাকলেও উত্তরাঞ্চলে নিম গাছ বেশি দেখতে পাওয়া যায়।
চর্ম রোগের জন্য নিম গাছ মহৌষধ স্বরূপ।নিয়ম মেনে ব্যবহার করলে এটি রক্ত পরিষ্কার করে ও চর্ম রোগ সারাতে সহায়তা করে। নিম জীবণুনাশক হিসেবে ভালো কাজ করে। বসন্ত রোগের চিকিৎসায় নিমপাতা বিশেষ কার্যকরী। এগুলোর পাশাপাশি শ্বাসকষ্ট,বাতজ্বর, একজিমা,স্ক্যাবিস,এলার্জি,রাতকানা,যকৃত ও লিভারের নানা জটিলতা,ডায়াবেটিস,দন্তরোগ, হৃদরোগ ইত্যাদি প্রশমনে ও দূরীকরণে নিম গাছের রয়েছে অত্যন্ত কার্যকরী ব্যবহার।
এরকম জানা -অজানা বিভিন্ন প্রজাতির ঔষুধি গাছ আমাদের চারপাশে রয়েছে। ওষুধি গাছ সম্বন্ধে প্রয়োজনীয় জ্ঞানের অভাবে এবং আমাদের অবহেলা,অসচেতনতার কারণে অনেক প্রজাতি এখন প্রায় বিলুপ্তির পথে।অথচ, আমরা বাণিজ্যিক ভাবে এসব ঔষুধি গাছ চাষ করে বিদেশে রপ্তানি করতে পারি এবং যথেষ্ট লাভবান হতে পারি। তাই বিভিন্ন ঔষুধি গাছ এবং এদের ব্যবহার সম্পর্কে পর্যাপ্ত তথ্য সংগ্রহ করে যথাসাধ্য পরিচর্যার মাধ্যমে এগুলোকে সংরক্ষণ করা আমাদের অবশ্য কর্তব্য।
আয়েশা আক্তার
বায়োটেকনোলজি এন্ড জেনেটিক ইন্জিনিয়ারিং বিভাগ,নোবিপ্রবি।
হেড অব কন্টেন্ট ক্রিয়েশন,বায়ো ডেইলি।
তথ্যসূত্র: