কিডনিতে পাথর- চিন্তার বিষয় কি!

মানবদেহের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গগুলোর মধ্যে কিডনি অন্যতম। কিডনি মানবদেহে রেচন প্রক্রিয়ার কাজ করে থাকে। কিডনির প্রধান কাজগুলো হল- রক্ত থেকে আমিষ বিপাকে তৈরি নাইট্রোজেনঘটিত বর্জ্য অপসারন করা, রক্তে সোডিয়াম, পটাশিয়াম, ফসফেট এবং ক্লোরাইডসহ বিভিন্ন আয়রনের পরিমান নিয়ন্ত্রন করা, রক্তে অম্ল ও ক্ষারের ভারসাম্য রক্ষা করা, দেহে প্রবিষ্ট প্রতিবিষ ও ভেষজ পদার্থ সমূহকে দেহ থেকে অপসারন করা। যখন দেহে বর্জ্য পদার্থের পরিমাণ বেড়ে যায় এবং সেই অনুযায়ী যদি দেহে পানির পরিমাণ কম থাকে তাহলে বর্জ্যগুলো কিডনিতে এসে গুচ্ছাকারে জমা হয়। এই বর্জ্য গুচ্ছকে একসাথে কিডনির পাথর বলা হয়।
বর্তমানে কিডনিতে পাথর হওয়া একটি পরিচিত সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। যুবক হতে শুরু করে বৃদ্ধ বয়সেও অনেকে এই সমস্যার মুখোমুখি হয়ে থাকে। সাধারণত মহিলাদের থেকে পুরুষদের কিডনিতে পাথর হওয়ার প্রবণতা বেশি দেখা যায়।
কিডনিতে পাথর হওয়ার কারণঃ
কিডনিতে পাথর হওয়ার পিছনে বেশ কিছু কারণ পরিলক্ষিত হয়। যখন মুত্রে ক্রিস্টাল গঠনকারী পদার্থের সংখ্যা বেড়ে যায় এবং একই সাথে ক্রিস্টাল গঠন রোধ করে এমন পদার্থের পরিমাণ কমে যায় তখন কিডনিতে পাথর হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেয়। এছাড়াও পর্যাপ্ত পানি পান না করা, অতিরিক্ত আমিষ জাতীয় খাবার খাওয়া, মুত্রে অতিরিক্ত ক্যালসিয়াম, ইউরিক অ্যাসিড ও অক্সালেট বিদ্যমান থাকা কিডনিতে পাথর হওয়ার অন্যতম কারণ। ক্যালসিয়াম ক্যাপসুল, অ্যান্টাসিড, ভিটামিন সি ক্যাপসুল, মাইগ্রেন কিংবা ডিপ্রেশন এর জন্য যেসব ওষুধ দেওয়া হয় সেগুলো সেবনেও কিডনিতে পাথর হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়।
কিডনিতে পাথরের ৪ টি প্রকার পরিলক্ষিত হয়ঃ
১. ক্যালসিয়াম পাথরঃ
বেশিরভাগ কিডনিতে পাথরই ক্যালসিয়াম পাথর। মূলত কিডনিতে পাথরটি ক্যালসিয়াম অক্সালেট রুপে বিদ্যমান থাকে। মানুষের দেহের লিভার থেকে অক্সালেট তৈরি হয়। কিছু ফলমূল, শাকসবজিতে প্রচুর পরিমানে অক্সালেট পাওয়া যায়। এছাড়াও বাদাম এবং চকোলেটেও প্রচুর পরিমানে অক্সালেট থাকে। এগুলো অতিরিক্ত খেলে ক্যালসিয়াম পাথর হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। আবার ক্যালসিয়াম ফসফেট আকারেও ক্যালসিয়াম পাথর হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
২. স্ট্রুভাইট পাথরঃ
মূত্রনালীর ইনফেকশন থেকে এই ধরণের পাথর সৃষ্টি হয়ে থাকে। ম্যাগনেসিয়াম, অ্যামোনিয়াম ও ফসফেট দ্বারা স্ট্রুভাইট পাথর গঠিত।
৩. ইউরিক অ্যাসিড পাথরঃ
অতিরিক্ত ডায়রিয়া কিংবা বদহজমের কারণে এই ধরণের পাথর হয়ে থাকে। এছাড়াও উচ্চ প্রোটিনযুক্ত খাবার খাওয়ার কারণেও ইউরিক এসিড পাথর হয়ে থাকে। ডায়বেটিস রোগীদের ইউরিক অ্যাসিড পাথর হওয়ার প্রবণতা বেশি দেখা যায়। এছাড়া কিছু জেনেটিক ফ্যাক্টরও দায়ী।
৪. সিস্টিন পাথরঃ
সিস্টিনুরিয়ায় আক্রান্ত রোগীদের এই ধরণের পাথর হতে বেশি দেখা যায়।
কিডনিতে পাথর হওয়ার লক্ষণঃ
সাধারণত কিডনিতে পাথর হলে সব রোগীই ব্যাথা অনুভব করে থাকেন। এছাড়াও বেশ কিছু লক্ষণ পরিলক্ষিত হয়।
১. পিঠে কিংবা পাজরের নিচে তীব্র ব্যাথা।
২. অন্ডকোষে ব্যাথা।
৩. ঘন ঘন প্রস্রাব হওয়া।
৪. প্রস্রাবের সাথে রক্ত বের হওয়া।
৫. বমি বমি ভাব।
৬. প্রস্রাবে অতিরিক্ত জ্বালাপোড়া হওয়া।
৭. প্রস্রাব আটকে যাওয়া।
৮. জ্বর আসা।
চিকিৎসা
উপরোক্ত লক্ষণগুলো দেখা দিলে বিলম্ব না করে তৎক্ষনাৎ ডাক্তারের শরণাপন্ন হওয়া উচিত। কিডনিতে পাথরের চিকিৎসা নির্ভর করে পাথরের আকার, পাথরটি কোন প্রকারের এবং পাথরটি মূত্রনালীকে ব্লক করে রেখেছে কিনা। সাধারণত রক্ত পরীক্ষা, মূত্র পরীক্ষা এবং আল্ট্রাসনগ্রাম করা হয়। প্রয়োজনে সিটি স্ক্যান করা হয়। বিভিন্ন পরীক্ষা করে যদি পাথরের আকার যদি ছোট পাওয়া যায় তাহলে সাধারণ ওষুধেই সেরে যায় এবং একই সাথে ডাক্তাররা প্রচুর পরিমাণ পানি পান করার নির্দেশ দেয়। পাথরের আকার বড় হলে শক ওয়েভ লিথিওট্রিপসি, ইউরেটেরোস্কোপি করার প্রয়োজন হয়। সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করলে সার্জারির প্রয়োজন পড়ে।
প্রতিরোধঃ
কিডনিতে পাথর প্রতিরোধের সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ পন্থা হলো প্রচুর পরিমাণে তরলযুক্ত খাবার খাওয়া যেমনঃ পানি, লেবুর শরবত, ডাবের পানি বেশি বেশি খেতে হবে। এছড়াও নিম্নোক্ত পন্থা অবলম্বন করে কিডনিতে পাথর হওয়ার সম্ভাবনা কমে যায়।
১. দুধ ও দুধ থেকে তৈরি সব ধরণের খাবার পরিহার করতে হবে।
২. ক্যালসিয়ামযুক্ত খাবার পরিহার করতে হবে।
৩. ইউরিক অ্যাসিড যুক্ত খাবার পরিহার করতে হবে।
৪. রেড মিট, সামুদ্রিক মাছ পরিহার করতে হবে।
৫. স্ট্রবেরি, টমেটো, ফুলকপি, কচুশাক, অ্যাসপারাগাস খাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে।
৬. চা ও কফি খাওয়া সীমিত করতে হবে।
৭. প্রতিদিন ৩০ মিনিট হাঁটার অভ্যাস করতে হবে।
৮. ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া যেকোনো ধরণের ডায়েট থেকে বিরত থাকতে হবে।
কিডনিতে পাথর হলে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী চললে খুব অল্প দিনেই সুস্থ হওয়া যায় এবং স্বাভাবিক জীবনযাপন করা যায়।
তথ্যসুত্রঃ
সাদী আহমেদ
৩য় বর্ষ
বায়োটেকনোলোজি অ্যান্ড জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং ডিসিপ্লিন
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়
https://www.kidneyfund.org/kidney-disease/kidney-problems/kidney-stones/