হিমোফিলিয়া – মহারাণী ভিক্টোরিয়ার বংশধর

হিমোফিলিয়া একটি উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া রক্তক্ষরণ সংক্রান্ত ব্যাধি যেখানে গুরুতর আঘাত বা সার্জারির পর রক্ত জমাট বাধায় জটিলতা দেখা যায়। রক্তে বিভিন্ন ধরনের প্রোটিন আছে যা রক্ত জমাট বাঁধতে সাহায্য করে। হিমোফিলিয়া আক্রান্ত ব্যক্তির শরীরে এ ধরনের প্রোটিন বা ফ্যাক্টর কম পরিমাণে উপস্থিত থাকে। একজন ব্যাক্তির হিমোফিলিয়ার তীব্রতা তার রক্তে উপস্থিত ফ্যাক্টর এর পরিমাণের ওপর নির্ভর করে। ফ্যাক্টর এর মান যত কম হবে, রক্তক্ষরণ ততই বেশি হবে কারণ রক্ত জমাট বাঁধায় জটিলতা দেখা দিবে এবং রোগীর মৃত্যুর ঝুঁকি ততই বাড়তে থাকবে। সাধারণত শিশুর জন্মের সাথে সাথেই মায়ের জিন থেকে সন্তানের দেহে সংক্রমণ হয় এবং সন্তান হিমোফিলিয়ায় আক্রান্ত হয়। পরিপূর্ণ বয়সে হিমোফিলিয়া হওয়ার ঘটনা খুবই বিরল।
হিমোফিলিয়ার প্রাচীন ইতিহাস
প্রাচীনকাল থেকে হিমোফিলিয়া নিয়ে বেশ উৎসাহের সাথে বিজ্ঞানীগণ গবেষণা শুরু করে। দ্বিতীয় শতাব্দীতে ইহুদীদিগের ধর্মশাস্ত্র থেকে জানা যায় যে দুই ভাই লিঙ্গাগ্রচর্মছেদন করার (মুসলমানি) পর অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের কারণে তারা মৃত্যুবরণ করে পরবর্তীতে সেখানে এই রীতি নিষিদ্ধ করা হয়। দ্বাদশ শতাব্দীর আরব দেশীয় চিকিৎসক, আলবুকাসিস একটি পরিবারের বর্ণনা করেন যেখানে একই পরিবারের সকল পুরুষ সদস্য অতি সামান্য আঘাতে রক্তক্ষরণ বন্ধ না হওয়ায় মারা যায়। প্রথমবারের মত আধুনিক হিমোফিলিয়ার বর্ণনা দেন জন কনরেড অট্টো , ফিলাডেলফিয়ার একজন শারীরতত্ত্ববিদ। তিনি ১৮০৩ সালে প্রকাশ করেন, “রক্তক্ষরণ সংক্রান্ত একটি নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য একটি নির্দিষ্ট পরিবারেই দেখা যায়।“ তিনি পরিষ্কারভাবে হিমোফিলিয়ার কিছু প্রধান বৈশিষ্ট্যের উল্লেখ করেন যেমনঃ পুরুষদের উত্তরাধিকার সূত্রে হিমোফিলিয়া হওয়ার প্রবণতা তুলনামূলকভাবে বেশি। তবে “হিমোফিলিয়া” শব্দটি প্রথম ব্যবহৃত হয় জুরিচ ইউনিভার্সিটির ‘’হফ’’ কর্তৃক ১৮২৮ সালে লিখিত একটি প্রবন্ধে।
হিমোফিলিয়াকে সাধারণত একটি “রাজকীয় ব্যাধি” বলা হয় কারণ ইউরোপিয়ান রাজপরিবারের বিভিন্ন সদস্য এই রোগটি বংশানুক্রমে বহন করে আসছে যেহেতু, ইংল্যান্ডের মহারাণী ভিক্টোরিয়া (১৮৩৭-১৯০১) হিমোফিলিয়া বি এর বাহক ছিলেন। তাঁর অষ্টম পুত্রসন্তান ‘লিওপোল্ড’ হিমোফিলিয়া বি তে আক্রান্ত ছিলেন। দুঃখজনকভাবে রাজকুমার লিওপোল্ড অসংখ্যবার রক্তক্ষরণ হয়ে নানান শারীরিক সমস্যার স্বীকার হন এবং শেষ পর্যন্ত সকল ভোগান্তির অবসান ঘটিয়ে মাত্র ৩১ বছর বয়সে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। মহারাণী ভিক্টোরিয়ার দুটি কন্যা ‘এলিস’ এবং ‘বিয়াত্রিস’ হিমোফিলিয়া বি এর বাহক ছিলেন এবং সেই সুবাদে স্প্যানিশ, রাশিয়া ও জার্মান রাজপরিবার গুলোতে ও হিমোফিলিয়ার বিস্তার ঘটে। কালক্রমে হিমোফিলিয়া রাজপরিবার গুলোতে এভাবেই বংশানুক্রমে স্থানান্তরিত হতে থাকে। তাই এটি রাজকীয় ব্যাধি নামেই খ্যাত।
হিমোফিলিয়া ও জেনেটিক্স
হিমোফিলিয়া একটি বংশগত প্রক্রিয়া অর্থাৎ পারিবারিক সূত্রে রোগটি স্থানান্তরিত হয়। এটি ফ্যাক্টর ৮, ৯ অথবা ১০ তৈরি হওয়ার জন্য দায়ী জিনগুলোর মধ্যবর্তী ত্রুটির কারণে হয়ে থাকে। এই জিনগুলো এক্স ক্রোমোজোমে থাকে তাই এটি একটি এক্স লিংকড ব্যাধি। প্রতিটি মানুষ জন্মসূত্রে তার বাবা মায়ের কাছ থেকে একজোড়া সেক্স ক্রোমোজোম পেয়ে থাকে। এক্ষেত্রে মেয়েদের দুটি এক্স ক্রোমোজোম এবং ছেলেদের একটি এক্স ও একটি ওয়াই ক্রোমোজোম থাকে। ছেলেদের ক্ষেত্রে এক্স ক্রোমোজোম মায়ের কাছ থেকে এবং ওয়াই ক্রোমোজোম বাবার কাছ থেকে আসে। মেয়েরা বাবা-মা উভয়ের কাছ থেকে একটি করে এক্স ক্রোমোজোম পেয়ে থাকে। যেহেতু ত্রুটিযুক্ত জিনটি এক্স ক্রোমোজোমে অবস্থান করে তাই বাবার দ্বারা ছেলের দেহে রোগটি স্থানান্তর হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। এটি নির্দেশ করে মায়ের মিউটেটেড এক্স ক্রোমোজোমটি যদি তার ছেলে সন্তান পায় তবে সে হিমোফিলিয়ায় আক্রান্ত হবে। যদি একজন নারীর একটি মিউটেটেড এক্স ক্রোমোজোম থাকে তবে সাধারণত তাকে ‘বাহক’ বলা হয়ে থাকে এবং ৫০% সম্ভাবনা থাকে তার সন্তান এর দেহে সংক্রমিত হওয়ার হোক সে ছেলে অথবা মেয়ে। তার মানে তিনি রোগটি স্থানান্তর করলেও নিজে আক্রান্ত নন কারণ তার স্বাভাবিক এক্স ক্রোমোজোমে যথেষ্ট পরিমাণ ক্লটিং ফ্যাক্টর আছে যা তাকে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ থেকে রক্ষা করে। তথাপি বাহক নারীদের রক্তক্ষরণের সম্ভাবনা তুলনামূলকভাবে বেশি। যেসব পুরুষদের মিউটেটেড এক্স ক্রোমোজোম থাকে তারা পরবর্তীতে তাদের ভূমিষ্ঠ হওয়া কন্যা সন্তানের মধ্যে স্থানান্তর করে যার ফলশ্রুতিতে সেই কন্যা সন্তান হিমোফিলিয়া বাহক হয়। নারীদের ক্ষেত্রে দুটি ক্রোমোজোমই যদি মিউটেটেড হয় তবেই তিনি হিমোফিলিয়ায় আক্রান্ত হবেন কিন্তু এটি বিরল ঘটনা।
অনেক প্রকারের হিমোফিলিয়া আছে এবং প্রায় সবগুলোই বংশগত। তবুও ৩০% হিমোফিলিয়ায় আক্রান্ত ব্যাক্তির পরিবারে হিমোফিলিয়ার পূর্ব ইতিহাস পাওয়া যায় না। তাদের ক্ষেত্রে অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে জিনের পরিবর্তন ঘটে যা হিমোফিলিয়ার জন্ম দেয়। স্বোপার্জিত হিমোফিলিয়া খুবই বিরল ঘটনা যেখানে ইমিউন সিস্টেম রক্তের ক্লটিং ফ্যাক্টরকে আক্রমণ করে এর সাথে আরো জড়িত আছে গর্ভধারণ, অটোইমিউন, ক্যান্সার ইত্যাদি।
হিমোফিলিয়া ‘এ’ এবং ‘বি’ হিমোফিলিয়ার দুইটি প্রধান প্রকারভেদ এবং নারীদের তুলনায় পুরুষের দেহে বেশি সংক্রমিত হয়। হিমোফিলিয়া ‘এ’ টাইপ সবচেয়ে বেশি দেখা যায় যা প্রতি ৪০০০-৫০০০ জন সদ্যোজাত ছেলেদের মধ্যে ১ জনের মধ্যে দেখা যায় অথচ হিমোফিলিয়া ‘বি’ প্রতি ২০০০০ জনের মধ্যে ১ জনের মধ্যে দেখা যায়। হিমোফিলিয়া ‘এ’ ক্লাসিক হিমোফিলিয়া নামেও পরিচিত যা ফ্যাক্টর ৮ তৈরির জিনে মিউটেশন ঘটায় অন্যদিকে, হিমোফিলিয়া ‘বি’ ফ্যাক্টর ৯ তৈরির জিনে মিউটেশন ঘটায়। ফ্যাক্টর ৮ এবং ফ্যাক্টর ৯ এর উভয় জিনই এক্স ক্রোমোজোমে অবস্থান করে।
যদি শুধুমাত্র মায়ের মিউটেটেড জিন থাকেঃ
বাহক নারী এবং সুস্থ পুরুষের বিয়ে হলে তাদের সন্তানের ক্ষেত্রে-
- ৪ জনের মধ্যে ১জন পুত্র সন্তান সুস্থ হবে।
- ৪জনের মধ্যে ১জন হিমোফিলিয়ায় আক্রান্ত পুত্র সন্তান হবে
- ৪ জনের মধ্যে ১জন কন্যাসন্তান সুস্থ হবে
- ৪ জনের মধ্যে ১জন কন্যা সন্তান বাহক হবে।
শেষ ক্ষেত্রে উক্ত কন্যাসন্তান পরবর্তীতে তার পুত্র সন্তানের মধ্যে হিমোফিলিয়া স্থানান্তর করবে কিন্তু নিজে শুধুমাত্র বাহক এক কাজ করবে।
যদি শুধুমাত্র বাবার মিউটেটেড জিন থাকেঃ
সুস্থ নারী এবং হিমোফিলিয়ায় আক্রান্ত পুরুষের বিয়ে হলে তাদের সন্তানের ক্ষেত্রে-
- ৪ জনের মধ্যে ২জন কন্যাসন্তান বাহক হবে
- ৪জনের মধ্যে ২জন স্বাভাবিক পুত্র হবে
কন্যাসন্তান দের মাধ্যমে পরবর্তী প্রজন্মে ছড়াবে।
উভয়ের মিউটেটেড জিন থাকলেঃ
বাহক নারী ও হিমোফিলিয়া আক্রান্ত পুরুষের সন্তানের ক্ষেত্রে –
- ৪জনের মধ্যে ১জন স্বাভাবিক পুত্র হবে
- ৪জনের মধ্যে ১জন পুত্র হিমোফিলিয়ায় আক্রান্ত হবে
- ৪ জনের মধ্যে ১জন বাহক কন্যাসন্তান হনে
- ৪জনের মধ্যে ১জন হিমোফিলিয়ায় আক্রান্ত কন্যাসন্তান হবে।
অর্থাৎ, এটি প্রমাণ করে যে নারীদেরও হিমোফিলিয়া হতে পারে যদিও এটি বিরল।
হিমোফিলিয়ার প্রকারভেদ
একজন হিমোফিলিয়ায় আক্রান্ত ব্যাক্তির লক্ষণগুলো তার রক্তে উপস্থিত ফ্যাক্টর এর অপর্যাপ্ততার উপর নির্ভর করে। রোগীর লক্ষণ এবং ফ্যাক্টর এর পরিমাণের উপর ভিত্তি করে মাইল্ড, মডারেট ও সিভিয়ার এই তিন ধরনের হিমোফিলিয়া দেখা যায়। একজন স্বাভাবিক মানুষের রক্তে প্লাজমায় ফ্যাক্টর ৮ এর পরিমাণ ৫০%-১০০% হয়ে থাকে। ৫০% এর কম এ ফ্যাক্টর লেভেল নেমে আসলেই হিমোফিলিয়া হয়ে থাকে।
মাইল্ড হিমোফিলিয়াঃ এ ধরনের হিমোফিলিয়ায় স্বাভাবিক ফ্যাক্টরের ৬%-৪৯% ফ্যাক্টর উপস্থিত থাকে এবং তাদের ক্ষেত্রে শুধুমাত্র ট্রমা, গুরুতর আঘাত অথবা সার্জারির পর রক্তক্ষরণ হয়। সাবালক হওয়া পর্যন্ত তাদের রক্তক্ষরণ শুরু হয় থাকে।
মডারেট হিমোফিলিয়াঃ এ ধরনের হিমোফিলিয়ায় স্বাভাবিক ব্লাড ফ্যাক্টরের ১%-৫% পর্যন্ত ফ্যাক্টর উপস্থিত থাকে এবং তার ক্ষেত্রেও জটিল আঘাত, সার্জারি বা ট্রমার সময় রক্তক্ষরণ হয়। তবে এক্ষেত্রে এ ধরনের হিমোফিলিয়ায় রোগীর কোনো কারণ ছাড়াই রক্তক্ষরণ হতে পারে যাকে স্বতঃস্ফূর্ত রক্তক্ষরণ বলা হয়।
সিভিয়ার হিমোফিলিয়াঃ এ ধরনের হিমোফফিলিয়ায় রক্তের ফ্যাক্টর লেভেল ১% এরও কম থাকে এবং জটিল বা সামান্য আঘাতেই রক্তক্ষরণ হয়। রোগীর জয়েন্ট এবং মাসেলে স্বতঃস্ফূর্ত রক্তক্ষরণ হয়।
একজন হিমোফিলিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তির রক্তের ফ্যাক্টর লেভেল মুহূর্তেই পরিবর্তন হয় না কারণ এটি তার জেনেটিক্স এর উপর নির্ভর করে। ন্যাশনাল হিমোফিলিয়া ফাউন্ডেশন এর মতে , হিমোফিলিয়া ‘এ’ তে আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে ৬০% সিভিয়ার হিমোফিলিয়া, ১৫% মডারেট হিমোফিলিয়া এবং বাকি ২৫% মাইল্ড হিমোফিলিয়ায় আক্রান্ত।
হিমোফিলিয়ার লক্ষণঃ
বাহ্যিক ব্লিডিং এর লক্ষণগুলোর মধ্যে রয়েছে-
*মুখের কোনো অংশ কেটে গেলে বা দাঁত পড়ে গেলে সেখান থেকে রক্তক্ষরণ শুরু হয়।
*কোনো নির্দিষ্ট কারণ ছাড়াই নাক থেকে রক্তপাত হয়।
*দেহের কোথাও কেটে গেলে সেখানে অনিয়ন্ত্রিত ভাবে রক্তক্ষরণ হয়।
অভ্যন্তরীণ রক্তক্ষরণের লক্ষণগুলোর মধ্যে রয়েছে-
*কিডনি অথবা ব্লাডার এ রক্তক্ষরিত হয়ে মূত্রের মাধ্যমে বের হয়।
*অন্ত্র ও পাকস্থলী তে রক্তক্ষরণ হয়ে মলের মাধ্যমে বের হয়।
*পেশীতে অভ্যন্তরীণ রক্ত জমাট বেঁধে চামড়ায় কালশিটে দাগ দেখা যায়।
*দেহের বিভিন্ন জয়েন্টে কোনো কারণ ছাড়াই রক্তক্ষরণ হয় যা পরবর্তীতে স্ফীত , গরম হয়ে যায় এবং বাঁকাতে কষ্ট হয়। রক্তক্ষরণের স্থায়িত্বকাল যত বেশি হবে ততই সন্ধিস্থল স্ফীত হবে। একই সাথে এটি অকথ্য যন্ত্রণা এবং সন্ধি ক্ষয় করে দেয় এবং ধীরে ধীরে চলাচল করার ক্ষমতা নষ্ট করে দেয়।
*মাথায় সামান্য বা গুরুতর আঘাতে রক্তক্ষরণ হলে সেটা দীর্ঘ সময় পর্যন্ত মাথা বা ঘাড় ব্যথা,বমি এমনকি খিচুনি ও হৃদরোগের কারণ হতে পারে।
বাংলাদেশে হিমোফিলিয়ার অবস্থা
ধারণা করা হয়, হিমোফিলিয়ায় আক্রান্তদের ৮০ শতাংশ রোগী উন্নয়নশীল দেশে বাস করে এবং তাদের মধ্যে প্রায় ৭০% রোগী ডায়াগনোসিস এর মধ্য দিয়ে যাচ্ছে এবং বাকি ১০% কোন প্রকার চিকিৎসা পাচ্ছে না। উন্নত দেশগুলোতে পর্যাপ্ত চিকিৎসা ব্যবস্থার কারণে হিমোফিলিয়াক দের গড় আয়ুষ্কাল একজন সুস্থ স্বাভাবিক মানুষের কাছাকাছি অথচ উন্নতশীল দেশে চিকিৎসার সুব্যবস্থার অভাবে বেশিরভাগ রোগীরা বিভিন্ন শারীরিক জটিলতায় ভোগে এবং অকাল মৃত্যুর স্বীকার হয়। উন্নত দেশগুলোর জন্য হিমোফিলিয়ার চিকিৎসা একটি বড় চ্যালেঞ্জস্বরূপ। উন্নত দেশের অধিকাংশ মানুষ হিমোফিলিয়া সম্পর্কে অজ্ঞাত যার ফলে তারা জানে না হিমোফিলিয়ার জন্য কি কি ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত। উন্নত দেশের সরকার এবং পরিবার গুলোর রিসোর্স অত্যন্ত সীমিত, এমনকি পরীক্ষণের জন্য পর্যাপ্ত যন্ত্রপাতি থেকে শুরু করে মেডিসিন পর্যন্ত সবকিছুই অপ্রতুল। বাংলাদেশে ন্যাশনাল রেজিস্ট্রি ফর হিমোফিলিয়া এখনো কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারছে না উপযুক্ত ডাটা সংগ্রহের অভাবে। হিমোফিলিয়াক দের এখনো সাধারণ ডাক্তারদের কাছ থেকে চিকিৎসা নিতে হয় আবার খুব কম সংখ্যক রোগী রাজধানীর কিছু উন্নত হাসপাতাল থেকে কিছু সুযোগ সুবিধা পাচ্ছে তাও আবার উচ্চ মূল্যে। তবে সাধারণত রক্তক্ষরণের পরই তারা ডাক্তারের শরণাপন্ন হয় যার কারণে রোগীর অবস্থা গুরুতর হয়ে যায়। হিমোফিলিয়া নিয়ে তেমন কোনো গবেষণাও দেশে নেই। পর্যাপ্ত জ্ঞানের ঘাটতির কারণে মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতেও সদ্যজাত শিশুর হিমোফিলিয়ার রিপোর্ট পাওয়া যায় নি। অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশগুলোর মত বাংলাদেশও হিমোফিলিয়ার চিকিৎসায় ব্যাপকভাবে পিছিয়ে আছে। ওয়ার্ল্ড ফেডারেশন অব হিমোফিলিয়া এর বৈশ্বিক জরিপ ২০১৪ অনুযায়ী, মাত্র ৩ টি হিমোফিলিয়া চিকিৎসা কেন্দ্র বাংলাদেশে রয়েছে। সেখানেও পর্যাপ্ত পরীক্ষণ যন্ত্র ও দক্ষ জনশক্তির অভাব রয়েছে। বাংলাদেশে মাত্র ৬৫৭ জন রোগী শনাক্ত হয়েছে তাদের মধ্যে ৫৬৪ জন হিমোফিলিয়া ‘এ’ এবং ৯৩ জন হিমোফিলিয়া ‘বি’ তে আক্রান্ত। কোয়াগুলেশন ফ্যাক্টর দেশের সারা বছরই অপ্রতুল। রাজধানীর কিছু প্রাইভেট ফার্মাসিউটিক্যাল গুলো উচ্চ মূল্যে ফ্যাক্টর গুলো সরবরাহ করে থাকে। ফ্যাক্টরের বিকল্প হিসেবে ক্রায়োপ্রিসিপিটেট, প্লাজমা থ্যারাপি দেশের পুরাতন কিছু হাসপাতালে পাওয়া যায়। তবে মেডিকেল ব্লাড ব্যাংক গুলোর সুযোগ সুবিধা সারাদেশে বৃদ্ধি পাচ্ছে যার কারণে আশা করে যায় যারা আর্থিক কারণে ফ্যাক্টর এর যোগান দিতে পারছে না তারা বিকল্প চিকিৎসা গুলো নিতে পারবে। বাংলাদেশ হিমোফিলিয়া সোসাইটি, বাংলাদেশ হেমাটোলজি সোসাইটি, বাংলাদেশ পেডিয়াট্রিক হেমাটোলজি সোসাইটি বর্তমানে হিমোফিলিয়ার চিকিৎসার উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছে।
ওয়ার্ল্ড হিমোফিলিয়া ফেডারেশন এর ভূমিকা
ওয়ার্ল্ড হিমোফিলিয়া ফেডারেশন একটি অলাভজনক সংস্থা যা হিমোফিলিয়া ও অন্যান্য রোগীদের সেবায় নিয়োজিত।সংস্থাটির যাত্রা শুরু হওঁয় ১৯৬৩ সালে, মন্ট্রিলে। ৫৭ বছর ধরে সংস্থাটির ব্যাপক উন্নয়ন ঘটে এবং বর্তমানে এর ১০৭ টি ন্যাশনাল অরগানাইজেশন রয়েছে। এর লক্ষ্য হচ্ছে হিমোফিলিয়া এবং সংশ্লিষ্ট রোগীদের শনাক্ত করা, তাদের চিকিৎসার উন্নয়ন করে, তাদের প্রয়োজনে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়া। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে ফ্যাক্টর গুলো স্বল্পমূল্যে দেয়ার জন্য বছরের নির্দিষ্ট সময়ে অনুদান দেয়। তাছাড়া বার্ষিক ভাবে গ্লোবাল সার্ভে প্রতি বছর প্রকাশ করা হয়।
হিমোফিলিয়ার সাথে বসবাস ও করণীয়
যেহেতু হিমোফিলিয়া একজন ব্যাক্তির জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত বয়ে বেড়াতে হয় তাই এটি বেশির ভাগ সময় ব্যাক্তির মানসিক পীড়ার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তাই অভিভাবকদের দায়িত্ব তার সন্তানকে সঠিকভাবে তার রোগ সম্পর্কে পুরো ধারণা দেয়া এবং একটি গাইডলাইন ফলো করা। হিমোফিলিয়া থাকা সত্ত্বেও একজন ব্যক্তি স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারে। খেলাধুলা, সুইমিং, শিক্ষা সব ক্ষেত্রেই একজন হিমোফিলিক ব্যক্তি অবদান রাখতে পারে। তবে ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী সব ধরণের কাজে অংশ নেয়া সম্ভব।
- ইসরাত জাহান প্রমি
শিক্ষার্থী, জিন প্রকৌশল ও জীবপ্রযুক্তি বিভাগ
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট
তথ্যসূত্র:
https://www.ucsfhealth.org/conditions/hemophilia/symptoms
https://www.medicinenet.com/hemophilia/article.htm
https://www.livescience.com/hemophilia.html
https://www.hemophilia.org/Bleeding-Disorders/Types-of-Bleeding-Disorders/Hemophilia-A
https://www.healthline.com/health/hemophilia
https://hemophilianewstoday.com/symptoms-of-hemophilia/
https://www.cdc.gov/ncbddd/hemophilia/facts.html
https://www.statpearls.com/kb/viewarticle/22748