মাইটোকন্ড্রিয়াল জিনোম এডিটিং : বায়োটেক দুনিয়ার নতুন বিস্ময়

ক্রিসপার/ক্যাস-৯ প্রযুক্তির সাহায্যে নিউক্লিয়ার জিনোম এডিটিং এখন আমাদের কাছে অনেক পরিচিত হলেও, মাইটোকন্ড্রিয়াল জিনোমে এর ব্যবহার খুব বেশি আলোচিত নয়। তবে, সম্প্রতি প্রকাশিত হওয়া নতুন দুইটি গবেষণাপত্র মাইটোকন্ড্রিয়াল জিনোম এডিটিংয়ের জগতে নতুন এক মাত্রা এনে দিয়েছে। এবিষয়ে একটু বিস্তারিত জানার আগেই চলুন কিছু পরিচিত টার্মগুলো আরেকবার ঝালিয়ে নিই, সাথে মাইটোকন্ড্রিয়াল জিনোম এডিটিং কীভাবে শুরু হলো তার ইতিহাস এবং কীভাবে এটি কাজ করে সেটা-ও জেনে আসি।
যেকোনো অর্গানিজমে ডিএনএ এর উপস্থিতি সাধারণত ঐ জীবের প্রতিটি কোষের নিউক্লিয়াসে বিদ্যমান থাকলেও অল্প পরিমাণ ডিএনএ কোষীয় অঙ্গাণু মাইটোকন্ড্রিয়াতে উপস্থিত থাকে। আর বিজ্ঞানীমহলে পরিচিত মুখ জেনিফার ডাউডনা, ফেং ঝ্যাং, এমানুয়েল শর্পেন্টিয়ের দের জিনোম এডিটিং রিলেটেড গবেষণাগুলো শুধুই নিউক্লিয়াসের জিনোম নিয়েই সীমাবদ্ধ। কিন্তু জেনেটিক ডিজিজ বা ডিসঅর্ডারগুলো যে সবসময় শুধু নিউক্লিয়াসের ভেতর থাকা বংশগতীয় বস্তুর মাধ্যমেই ঘটবে এমনটা তো আর না, মাইটোকন্ড্রিয়াল জিনোমের মাধ্যমে ঘটে এমন বেশ কিছু ডিসঅর্ডার বিজ্ঞানীরা বেশ আগেই খুজে বের করে ফেলেছেন বলা যায়। উদাহরণস্বরূপ মানুষের অটিজম সমস্যার কথা বলা যেতে পারে। এছাড়াও হার্ট ডিজিজ, নিউরোলজিকাল ডিজিজ, মাসকুলার ডিজিজে ডিফেক্টিভ মাইটোকন্ড্রিয়ার উপস্থিতি খুজে পাওয়া গেছে। প্রতি ১,০০,০০০ মানুষের মধ্যে ৫ থেকে ১৫ জন মানুষের শরীরে মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিজিজ হওয়ার সম্ভাবনা আছে। মাইটোকন্ড্রিয়ার অনেক মিউটেশনও মানুষের জন্য ক্ষতিকর হওয়ার প্রমাণ মিলেছে। এমনকি, ক্যান্সারের জন্য দায়ী প্রতি ৩০ টি মোস্ট মিউটেটেড জিনের ২৫ টিই মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ তে পাওয়া যায়। এছাড়াও শতকরা ৭০ ভাগেরও বেশি কোলোরেকটাল ক্যান্সারে আক্রান্ত কোষে অন্তত একটি মিউটেটেড মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ পাওয়া গেছে। এপর্যন্ত মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ এর ২৭০ এরও বেশি জীবাণুপ্রকরণ পাওয়া গেছে। এতসব কারণে বিজ্ঞানীরা অনেকদিন ধরেই মাইটোকন্ড্রিয়ার জিনোমে পরিবর্তন আনার উপায় খুজে বের করার চেষ্টা করছিলেন। জিঙ্ক-ফিংগার নিউক্লিয়েজ (জেডএফএন), ট্যালেনসহ সর্বশেষ ক্রিসপার/ক্যাস-৯ প্রযুক্তি দিয়েও মাইটোকন্ড্রিয়াতে জেনেটিক পরিবর্তন আনা সম্ভব হয়নি। প্রধান কারণ, মাইটোকন্ড্রিয়ার বাইরের দ্বিস্তরবিশিষ্ট আবরণী ভেদ করা ক্যাস-৯ প্রোটিনের পক্ষে সম্ভব নয়। এছাড়া মাইটোকন্ড্রিয়াতে ডিএনএ এর পরিমাণ ক্ষুদ্র হওয়ায় সেখানে কাঙ্ক্ষিত এডিটিং সাইট খুজে বের করা এবং মাইটোকন্ড্রিয়াল ম্যাট্রিক্সে গাইড আরএনএ যোগ করাও বেশ কঠিন একটি কাজ। এইসকল সমস্যার সমাধানের শুরুটি মোটেও পরিকল্পনা করে হয়নি। চলুন, সেই ইতিহাসটাও জেনে নিই!
যুক্তরাষ্ট্রের সিয়াটলের ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটির অণুজীববিজ্ঞানী জোসেফ মোগাস এবং তার দল কাজ করছিলেন ব্যাকটেরিয়ার মধ্যকার দ্বন্দ্ব নিয়ে (উদ্দেশ্য ছিল এর মাধ্যমে ব্যাকটেরিয়া কেন বিভিন্ন জীবে রোগ সৃষ্টি করে তা আরো ভালোভাবে বোঝা), এসময় তারা লক্ষ করেন, Burkholderia cenocepacia নামের এক প্রজাতির ব্যাকটেরিয়া নিজেদের মধ্যে মারামারি করার সময় এক ধরনের টক্সিন সৃষ্টি করে থাকে, এই টক্সিনটি অন্য ব্যাকটেরিয়াদেরকে মেরে ফেলার চেষ্টা করে। এই টক্সিন কীভাবে সৃষ্টি হয় তা জানতে গিয়ে, কারণ হিসেবে খুজে পাওয়া যায় এক বিশেষ ধরনের এনজাইম। নাম DddA! ব্যাকটেরিয়ার শরীরে থাকা এই বিশেষ ধরনের এনজাইম নিয়ে বিস্তারিত জানতে গিয়ে জোসেফ মোগাসের দল এক বিশাল চাঞ্চল্যকর তথ্য খুজে পান। ঘটনা হচ্ছে, এই এনজাইমটি ব্যাকটেরিয়ার ডিএনএ সিকুয়েন্সে থাকা বেজ সাইটিডিন কে ইউরাসিলে পরিবর্তন করে। কিন্তু, ডিএনএ তে যেহেতু ইউরাসিল থাকেনা তাই এই ইউরাসিল অনেকটা থাইমিনের মতো কাজ করতে শুরু করে, আর ডিএনএ রেপ্লিকেশনের পর এটি পুরোপুরি থাইমিন হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। অর্থাৎ, আমরা সারাংশ করতে পারি এভাবে যে, DddA এনজাইমটি ব্যাকটেরিয়ার ডিএনএ সিকুয়েন্সে থাকা বেস সাইটোসিন কে থাইমিনে পরিবর্তন করে। আর এভাবে, একটি বেসকে সরাসরি অন্য আরেকটি বেসে পরিবর্তন করাটিকেই বলা হয় বেজ এডিটিং। জোসেফ মোগাস ও তার দল এরপর আরও গবেষণা করে দেখতে পান যে, অধিকাংশ এনজাইম (যেমন ক্যাস-৯) যেখানে শুধুমাত্র সিংগেল স্ট্রান্ডে পরিবর্তন আনতে পারে; সেখানে এই DddA এনজাইমটি ডাবল স্ট্রান্ডেড ডিএনএকে মডিফাই করতে সক্ষম। তখন তাদের মাথায় আসে ডাবল স্ট্রান্ডেড মাইটোকন্ড্রিয়াল জিনোম এডিটিং এর বিষয়ে এবং সেখানে তারা সাফল্য পেতে সক্ষম হন। কিন্তু সামনে আসে নতুন আরেক প্রশ্ন। এই এনজাইমটিকে নিয়ন্ত্রিত উপায়ে নিজেদের ইচ্ছানুযায়ী ডিএনএ এর স্পেসিফিক সাইটে কীভাবে ব্যবহার করা যেতে পারে? কারণ যদি অনিয়ন্ত্রিতভাবে এটি কাজ করতে শুরু করে, তাহলে হয়ত সিকুয়েন্সের সকল সাইটোসিনকেই থাইমিন বেজে পরিবর্তন করে ফেলবে। এই সমস্যাটির সমাধান করার জন্য জোসেফ মোগাস ও তার দল প্রথমে এই এনজাইমকে দুটি নিষ্ক্রিয় ভাগে ভাগ করে ফেলেন। এরপর এই অংশ দুটির সাথে ডিএনএ বাইন্ডিং প্রোটিন যুক্ত করে, জিনোমের কাঙ্ক্ষিত ডিএনএ সিকুয়েন্স এর স্পেসিফিক সাইটে যুক্ত করেন। এর ফলে, যখন এই বাইন্ডিং প্রোটিনগুলো আলাদা আলাদাভাবে কিন্তু উভয়ই মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ সংলগ্ন জায়গায় যুক্ত হয় তখন DddA এনজাইমের দুটি ভাগও একত্রিত হয়ে আবার সংযুক্ত হয় এবং কার্যকরভাবে নির্দিষ্ট সাইটোসিন কে থাইমিনে রুপান্তর করে। গত ৮ জুলাই ২০২০ তারিখে জোসেফ মোগাস ও তার দল তাদের এই গবেষণা সাফল্য বিখ্যাত বিজ্ঞান সাময়িকী নেচারে প্রকাশ করেন। এই গবেষণার পরিপ্রেক্ষিতে বিখ্যাত বিজ্ঞানী ডেভিড লিউ দেখান যে, এভাবে CG বেজপেয়ারকে AT বেজপেয়ারেও পরিবর্তন করা সম্ভব। এটি বেজ এডিটিং গবেষণাতে একটি মাইলফলক। এই গবেষণাগুলো ক্লিনিক্যাল লেভেলে নিয়ে আসতে এখনও অনেক স্টাডি, বিতর্ক, রিসার্চ, ট্রায়াল বাকি। কিছু দেশ ইতোমধ্যেই ভ্রুণ এবং ডিম্বাণুতে ডিসঅর্ডারমুক্ত এবং সুস্থ-সবল মাইটোকন্ড্রিয়ার মাইটোকন্ড্রিয়াল রিপ্লেসমেন্ট প্রসেস চালু করেছেন। আশা করা যাচ্ছে, অদুর ভবিষ্যতে হয়ত সকল প্রকার মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিসঅর্ডার ও ডিজিজের প্রতিকার আবিষ্কার করা সম্ভব হবে।
চলুন, আলোচনা শেষ করার আগে আবার একদম শুরুতে বলা সেই দু’টি গবেষণাপত্রে ফিরে যাই। প্রথম গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হয়েছে Science China Life Sciences জার্নালে। এখানে, বিজ্ঞানীরা মাইটোকন্ড্রিয়াল জিনোম এডিটিং করতে ক্রিসপার/ক্যাস-৯ ই ব্যবহার করেছেন। ক্রিসপার যাতে কাজ করতে পারে এজন্য তারা মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ তে মাইক্রোহোমোলোগাস অঞ্চল খুজে পেয়েছেন যেখানে এডিটিং উপযোগী সাইট রয়েছে। আর দ্বিতীয় গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হয়েছে Trends in Molecular Medicine জার্নালে। এখানের গবেষণাও মাইটোকন্ড্রিয়াল ও নিউক্লিয়ার জিনোম এডিটিং কে বিভিন্ন দিক থেকে বিশ্লেষণ করেছে। এভাবে এগিয়ে যাক মাইটোকন্ড্রিয়াল জিনোম এডিটিং গবেষণ। নির্মূল হোক মাইটোকন্ড্রিয়াল জিনোমে মিউটেশনের মাধ্যমে সৃষ্ট সকল রোগ। এই প্রত্যাশায়, আজ এপর্যন্তই। আমাদের সাথেই থাকুন।
মোঃ রাসেল উদ্দিন
জেনেটিক ইন্জিনিয়ারিং এন্ড বায়োটেকনোলজি ডিপার্টমেন্ট,
যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
References:
01. https://phys.org/news/2021-02-crispr-mitochondria-biotech.amp
02. https://www.nature.com/articles/d41586-020-02054-5
03. https://www.nature.com/articles/d41586-020-02094-x
04. https://www.nejm.org/doi/10.1056/NEJMcibr2025332