জিন থেরাপি- চিকিৎসা বিজ্ঞানে এক যুগান্তকারী আবিষ্কার।

সভ্যতার বিকাশের সাথে সাথে চিকিৎসা বিজ্ঞানেরও বিকাশ হয়েছে। প্রাচীনকালের চিকিৎসা পদ্ধতি থেকে আধুনিককালের চিকিৎসা পদ্ধতির বিস্তর পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। তবে আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের বয়সও কিন্তু বেশিদিন হয় নি। কিন্তু আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞান যে বিপ্লব ঘটিয়েছে তা সন্দেহাতীত। তার মধ্যে অন্যতম হলো জিন থেরাপি।
জিন থেরাপি কি?
প্রত্যেকটি জীবদেহ কোটি কোটি কোষ (Cell) দিয়ে তৈরি এবং প্রত্যেকটি কোষই নির্দিষ্ট জিনের বাহক। এই জিনগুলো বিভিন্ন প্রোটিন উৎপাদনের মাধ্যমে জীবদেহের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য প্রকাশ করে থাকে। যখন কোনো জিন ত্রুটিপূর্ণ হয়ে যায় তখন তার থেকে উৎপাদিত প্রোটিনও ত্রুটিপূর্ণ হবে যার ফলে জীবের বৈশিষ্ট্য প্রকাশে বাধাপ্রাপ্ত হবে কিংবা ত্রুটিপূর্ণ বৈশিষ্ট্য প্রকাশিত হবে।
জিন থেরাপি হলো ত্রুটিপূর্ণ জিনের চিকিৎসায় রিকম্বিনেন্ট ডিএনএ প্রযুক্তির প্রয়োগ। অর্থাৎ ত্রুটিপূর্ণ জিনকে পরীক্ষাগারে তৈরিকৃত ত্রুটিমুক্ত জিন দ্বারা প্রতিস্থাপন করার নামই হলো জিন থেরাপি। এর ফলে জীবদেহ সঠিক প্রোটিন উৎপাদনে সক্ষম হয়। এখন পর্যন্ত প্রায় চার হাজারেরও বেশি রোগ শনাক্ত হয়েছে যার কারণ ত্রুটিপূর্ণ জিন। একটি গবেষণায় দেখা গেছে প্রতি বছর আমেরিকাতে প্রায় এক হাজারের বেশি শিশু ত্রুটিপূর্ণ জিনের কারণে মারা যায়।
জিন থেরাপির প্রকারভেদ
এখন পর্যন্ত দুই ধরণের জিন থেরাপি আবিষ্কৃত হয়েছে।
১. সোম্যাটিক কোষ জিন থেরাপি (Somatic cell gene therapy)
এই ধরণের জিন থেরাপিতে রক্তকোষ বা ত্বকের কোষে পরিবর্তন আনা হয়। জননকোষ বা স্টেমকোষে এই ধরণের জিনের পরিবর্তন করা যায় না। এই পদ্ধতিতে রক্ত বা ত্বক থেকে ত্রুটিপূর্ণ জিন সংগ্রহ করে তাতে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন এনে আবার শরীরে প্রতিস্থাপন করা হয়। এছাড়াও শরীরে অবস্থিত কোষের জিনেও পরিবর্তন আনা যায়। সিস্টিক ফিব্রোসিস, থ্যালাসেমিয়া ও হিমোফিলিয়ার চিকিৎসায় সোম্যাটিক কোষ জিন থেরাপি ব্যবহার করা হয়।
২. জার্মলাইন জিন থেরাপি (Germline gene therapy)
এই জিন থেরাপিতে জননকোষে মূল পরিবর্তন আনা হয়। সাধারণত ত্রুটিপূর্ণ নিষিক্ত ডিম্বাণুতে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন এনে আবার মাতৃগর্ভে স্থাপন করা হয়। এতে করে পরিবর্তিত জিনের বৈশিষ্ট্যগুলো পরবর্তী প্রজন্মগুলোতে স্থানান্তরিত হয়। তবে প্রযুক্তিগত, নিরাপত্তাজনিত ও নীতিগত দিক বিবেচনা করে ইতিমধ্যে অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, হল্যান্ড, ইসরাইল, জার্মানি এবং সুইজারল্যান্ডে জার্মলাইন জিন থেরাপি নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কারণ ধারণা করা হয় এটি ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য হুমকিস্বরূপ।
পুর্বেই আমরা জেনেছি, জিন থেরাপিতে ত্রুটিপূর্ণ জিনের জায়গায় পরিবর্তিত জিনকে স্থাপন করা যায়। কিন্তু এর জন্য দরকার একটি কার্যকরী বাহন ব্যবস্থা। বাহনের জন্য প্রয়োজন বাহকের। বর্তমানে দুই ধরণের বাহক বিদ্যমান।
১. ভাইরাল বাহক
বর্তমানে বহুল ব্যবহৃত বাহক হলো ভাইরাস। আমরা জানি, ভাইরাস মানবকোষে তাদের জিন ছড়িয়ে দিতে সক্ষম। বর্তমানে রেট্রোভাইরাস, এডিনোভাইরাস, এডিনো-অ্যাসোসিয়েটেড ভাইরাস, হার্পিস ভাইরাস ও ভ্যাক্সিনিয়া ভাইরাস ভাইরাল বাহক হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। তন্মধ্যে রেট্রোভাইরাস, এডিনোভাইরাস ও এডিনো-অ্যাসোসিয়েটেড ভাইরাস বেশি ব্যবহৃত হয়।
- রেট্রোভাইরাস
রেট্রোভাইরাস সর্বপ্রথম ব্যবহৃত বাহক। এই ভাইরাসটি অন্য সবার থেকে আলাদা কারণ এটি তথ্য পরিবহনের জন্য আরএনএ (RNA) ব্যবহার করে থাকে। এই ভাইরাস প্রথমে যেকোনো একটি কোষকে আক্রান্ত করে রিভার্স ট্রান্সক্রিপ্টেজ এনজাইমের সহায়তায় তাদের জিনের প্রতিরূপ ডিএনএ তৈরি করে। তারপর ইন্টিগ্রেজ এনজাইমের সাহায্যে সদ্য তৈরি ডিএনএকে আক্রান্ত ডিএনএ এর সাথে একত্রিত করে। এই ভাইরাস বহুলভাবে ব্যবহৃত হলেও এটি শুধুমাত্র বিভাজনরত কোষেই কার্যকর। যেমন রক্তকোষ। - এডিনো ভাইরাস
যদি কোনো কোষে সঠিকভাবে জিন প্রতিস্থাপন না হয় তখন এডিনোভাইরাসকে বাহক হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এই ভাইরাস রেট্রোভাইরাস থেকেও বেশি কার্যকর কারণ এটি বিভাজমান কোষেও একইভাবে কাজ চালিয়ে নিতে সক্ষম। যেমনঃ যকৃতকোষ। রেট্রোভাইরাসের মত এই ভাইরাসের পরিবাহিত জিন সম্মিলিত না হয়ে নিউক্লিয়াসে অবস্থান করে। ফলে ত্রুটিমুক্ত জিনের প্রতিলিপি তৈরি হয় না কিন্তু অন্যান্য জিনের বিকাশ ঘটে থাকে। - এডিনো-অ্যাসোসিয়েটেড ভাইরাসঃ
বাহক হিসেবে এটি সবচেয়ে কার্যকরী ভাইরাস। কারণ এটি সব ধরণের কোষে সমানভাবে কাজ করতে সক্ষম। বিজ্ঞানীরা হিমোফিলিয়া প্রতিরোধে এই ভাইরাসকে ব্যবহার করার চেষ্টা করে যাচ্ছে।
২. নন-ভাইরাল বাহক
জিন থেরাপির নন-ভাইরাল পদ্ধতি হলো কাইমেরাপ্লাস্টি। কাইমেরাপ্লাস্টি আরএনএ ও ডিএনএ এর কৃত্রিম সূত্রক ব্যবহার করে ডিএনএ এর পরিবর্তন ঘটায়। এই কৃত্রিম সূত্রককে কাইমেরাপ্লাস্ট বলে। কাইমেরাপ্লাস্ট কোষের ভিতরে প্রবেশ করে একটি জিনের সাথে সংযুক্ত হয় এবং পরিপূরক বেস গুলোর মধ্যে বন্ধন ঘটে। কিন্তু মধ্য সূত্রকে কোনো বন্ধন হয় না। তাই ডিএনএ সংস্কারক এনজাইম ত্রুটিযুক্ত বা আক্রান্ত ডিএনএ গুলোকে প্রতিস্থাপিত করে। কিন্তু এর কার্যকরীতা নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক রয়েছে। প্রতিবেদনে দেখা গেছে মানবকোষে এর কার্যকরীতা শতকরা ৫০ ভাগ। ফিব্রোব্লাস্টে এর কার্যকরীতা শতকরা ০.৪-২.৪ ভাগ ও ঈস্ট কোষে শতকরা ০.০০০২ ভাগ।
সীমাবদ্ধতা ও জটিলতা
- জিন পরিবর্তনের ফলে রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটতে পারে যা ভালো ফল বয়ে নাও আনতে পারে।
- পরিবর্তিত জিনগুলো দীর্ঘ সময় ধরে তার কার্যকরীতা ধরে রাখবে কিনা তা এখনও নিশ্চিত নয়।
- ভাইরাল বাহকগুলো বিষাক্ত হতে পারে কিছু ক্ষেত্রে যা রোগীর জন্য মারাত্মক প্রভাব ফেলতে পারে।
- জিন থেরাপি অনেক ব্যয়বহুল চিকিৎসা।
- আংশিক সফল জিন থেরাপির ফলে নতুন কোনো রোগের সৃষ্টি হতে পারে।
- এছাড়াও জার্মলাইন জিন থেরাপি নৈতিকতার পরিপন্থি বলে বিবেচিত হয়।
যদিও চিকিৎসা হিসেবে জিন থেরাপি এখনও প্রাথমিক পর্যায়ে আছে তবে এর সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারলে এটি মানবজীবনে এক নতুন আলোর সঞ্চার তৈরি করবে। কারণ দুরারোগ্য ব্যাধি নির্মূলকরণে জিন থেরাপির কোনো বিকল্প নেই।
সাদী আহমেদ
বায়োটেকনোলোজি অ্যান্ড জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং ডিসিপ্লিন
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়
তথ্যসূত্রঃ
https://link.springer.com/chapter/10.1007/978-3-642-60829-2_2