কোভিড ভ্যাক্সিন এবং এর নিরাপত্তা

প্রাণঘাতী কোভিড-১৯ এর প্রতিকার ও প্রতিরোধ হিসেবে আমরা কত কিছুই না করছি। তবে ভাবনার বিষয় এই যে, আমাদের আগামী প্রজন্মকে কিন্তু করোনা ভাইরাসকে সাথে নিয়েই বাঁচতে হবে। এই পৃথিবীতে যত মহামারী এসেছে, তার কোনটিই পৃথিবী ছেড়ে যায়নি। তবে মানুষ শিখে নিয়েছে তাদের সাথে নিয়েই কিভাবে বেঁচে থাকা যায়। এই ক্ষেত্রে ভ্যাক্সিনের ভূমিকা অতুলনীয়।
ভ্যাক্সিন কিভাবে রোগ প্রতিরোধে কাজ করে?
প্রতি বছর আমাদেরকে শত শত রোগের হাত থেকে রক্ষার দায়িত্ব পালন করে চলেছে ভ্যাক্সিন। ভ্যাক্সিনের মাধ্যমে ইমিউনাইজেশন দ্বারা বর্তমানে ডিপথেরিয়া, ইনফ্লয়েঞ্জা, টিটেনাসের মতো আরো অনেক রোগের থেকে প্রায় ২০-৩০ লক্ষ্য মৃত্যুকে ঠেকানো হয়। তবে ভ্যাক্সিনের কার্যকারিতা সম্পর্কে আমরা ঠিক কতটা জানি?
ভ্যাক্সিন মূলত আমাদের দেহের ইমিউনিটি বা প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করে। ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়ার দেহের কিছু নির্দিষ্ট অংশ রোগ সৃষ্টির কারণ। রোগ সৃষ্টি করে না, এমন অংশকে ভ্যাক্সিন আকারে দেহে প্রবেশ করানো হয়। এর ফলে আমাদের দেহের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ধীরে ধীরে এর বিরুদ্ধে প্রস্তুতি নিতে থাকে। ইমিউনোলজিতে বলা হয়, নাইভ সেলগুলো (primary T cell) যখন ভ্যাক্সিনের সংস্পর্শে আসে, তারা Memory cell তৈরী করে। মেমরি সেলের কাজ হলো ভ্যাক্সিন, অর্থাৎ এই ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়া ভগ্নাংশগুলোকে চিনে রাখা এবং প্রয়োজনীয় এন্টিবডি তৈরী করা, যাতে পরবর্তীতে রোগ সৃষ্টিকারী অণুজীবের আক্রমণে ইমিউনিটি দ্রুত কাজ করতে পারে।
কোভিড-১৯ থেকে রক্ষার স্থায়ী সমাধানও হলো ভ্যাক্সিন। বর্তমানে ১৬৯টি কোভিড-১৯ ভ্যাক্সিন ক্যান্ডিডেটকে COVAX এর তত্ত্বাবধানে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হচ্ছে। এর মধ্য থেকে ২৬টি ক্যান্ডিডেটকে মানবদেহে ট্রায়ালও (human trial) দেয়া হয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (World Health Organization – WHO) বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ও বৈশ্বিক সংস্থার সাথে এই নিয়েই কাজ করে যাচ্ছে। তবে প্রশ্ন দাঁড়াচ্ছে যে, “কখন এবং কিভাবে বুঝবো কোভিড-১৯ ভাক্সিন কতটা নিরাপদ এবং কার্যকরী?”
কোভিড-১৯ প্রতিরোধে ভ্যাক্সিন
৩য় পর্যায়ের ট্রায়ালের ওপর ভিত্তি করে ধারণা করা হচ্ছে যে, এ বছরের শেষ দিকে একাধিক ভাক্সিনকে নিরাপদ ও কার্যকরী কোভিড ভ্যাক্সিন হিসেবে অনুমোদন দেয়া হতে পারে। Phase-3 তে দুই ধরনের ভ্যাক্সিন নিয়ে কাজ করা হচ্ছে যার একটি Moderna ও BioNTech/Pfizer ভ্যাক্সিন এবং অন্যটি Oxford/AstraZeneca ভাইরাল ভেক্টর ভ্যাক্সিন।
SARS-CoV-2 স্পাইক গ্লাইকোপ্রোটিন ভাইরাসটিকে মানব কোষের সাথে সংযুক্ত করে, যার কারণে ভাইরাস মানবদেহে প্রবেশ করতে পারে। উপরোক্ত দুই ধরনের ভ্যাক্সিনেই স্পাইক গ্লাইকোপ্রোটিন ব্যাবহার করা হয়। ফলস্বরূপ মানবদেহের প্রতিরক্ষা ব্যাবস্থা ত্বরান্বিত হয় এবং দেহে প্রতিরক্ষামূলক এন্টিবডি তৈরী হয়, যা পরবর্তীতে SARS-CoV-2 ভাইরাসকে কোষের সাথে সংযুক্ত হতে বাঁধা দেয়।
১ম ভ্যাক্সিনটি হলো Moderna এর নিউক্লিক এসিড ভ্যাক্সিন। এর ক্ষেত্রে স্পাইক গ্লাইকোপ্রোটিনটি প্রস্তুতকারী mRNA ফ্যাট ড্রপলেট লাইপোসোমে আবদ্ধ করা হয়। এভাবে mRNA গুলোর প্রতিটি কোষে পৌঁছানো নিশ্চিত করা হয়। mRNA গুলো কোষে পৌঁছে গেলে কোষের নিজস্ব ব্যাবস্থাপনায় mRNA থেকে স্পাইক গ্লাইকোপ্রোটিন তৈরী চলতে থাকবে যা মানবদেহে প্রোটিনটির বিরুদ্ধে এন্টিবডি তৈরীকে ত্বরান্বিত করবে।
অপরদিকে, Oxford/AstraZeneca এর কার্যপ্রণালি কিছুটা ভিন্ন। শিম্পাঞ্জীর দেহে প্রাপ্ত একটি এডিনোভাইরাসের দেহেও স্পাইক গ্লাইকোপ্রোটিন তৈরীর হদিস পাওয়া যায়। Oxford/AstraZeneca এর ক্ষেত্রে এই এডিনোভাইরাসকেই ব্যবহার করা হয়।
কোভিড ভ্যাক্সিনের কার্যকারিতা ও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া
মানুষ-ভিন্ন অন্যান্য প্রাণীদের উপর এই ভ্যাক্সিন প্রয়োগে দেখা গেছে তাদের দেহে এমন একটি এন্টিবডি তৈরী হয় যা তাদেরকে করোনার আক্রমণ থেকে রক্ষা করে। উদাহরণস্বরূপ, হ্যামস্টারের দেহে এডিনোভাইরাস ভাইরাল ভ্যাক্সিন প্রয়োগে তারা নিউমোনিয়া, ওজন হ্রাস ও অকাল মৃত্যু থেকে রক্ষা পায়। অন্যান্য প্রাণীদেহে mRNA ভ্যাক্সিন প্রয়োগে তাদের ফুসফুসে ভাইরাসের পরিমাণ কমে এবং বেশ কিছু প্রাণী এন্টিবডি তৈরীতে সক্ষম হয়।
তবে মানবদেহে এর প্রতিক্রিয়া কেমন?
২৮ দিনের পর্যবেক্ষণে ১ম ও ২য় পর্যায়ে ১০০ জনের উপর ট্রায়াল দেয়া হয় যেখানে কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া পরিলক্ষিত হয়। এর মধ্যে হালকা জ্বর, ক্লান্তি, মাংসপেশিতে ব্যাথা ইত্যাদির উল্লেখ রয়েছে। ৩য় পর্যায়ে এধরনের কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া এখন পর্যন্ত প্রকাশ না পেলেও একজন ব্যক্তির মেরুদণ্ডে (spinal cord) ইনফ্লামেশন দেখা যায়। তবে তা ভ্যাক্সিনেরই প্রতিক্রিয়া কিনা তার ব্যাপারে নিশ্চিত হননি গবেষকরা।
অতএব, প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে, “কোভিড ভ্যাক্সিন মানবদেহের জন্য ঠিক কতটা নিরাপদ ও কার্যকরী?”
ভ্যাক্সিনের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে FDA এর ভূমিকা
কোভিড ভ্যাক্সিনের লাইসেন্স প্রাপ্তির জন্য ফুড এন্ড ড্রাগ এডমিন্সট্রেশন (FDA) কিছু নীতিমালা ধার্য করেছে যার প্রধান উদ্দেশ্য সকলের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ। এমনকি প্রতিদ্বন্দ্বী ভ্যাক্সিন ইন্ডাস্ট্রিগুলোও নিরাপত্তার খাতিরে লাইসেন্সের জন্য তাড়াহুড়ো না করার প্রতিশ্রুতিতে আবদ্ধ হয়েছে।
৩য় পর্যায়ের ভ্যাক্সিনের অনুমোদনের শর্তস্বরূপ FDA প্রাথমিকভাবে ভ্যাক্সিনগুলোর ৫০% নিরাপত্তা দাবী করেছে, যার মধ্যে বিভিন্ন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া যেমন, SARS-CoV-2 ইনফেকশন, জ্বর, ঠাণ্ডা, কাশি, শ্বাসকষ্ট, স্বর্দি, ক্লান্তি, মাংসপেশিতে ব্যাথা, স্বাদ ও গন্ধহীনতা, ডায়রিয়া, বমিভাব ইত্যাদি থেকে নিরাপত্তা দাবী করা হয়েছে। অর্থাৎ, আকাঙ্ক্ষিত ভ্যাক্সিন থেকে এধরনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার হার অন্তত অর্ধেক পরিমাণ কমাতে হবে। তবে এক্ষেত্রে চিন্তার বিষয় হলো, ভ্যাক্সিন প্রাপ্ত মানুষের ধারণা থাকতে পারে যে তারা সম্পূর্ণ সুরক্ষিত যা তাদের মাস্ক পরিধান ও সামাজিক দুরত্ব বজায় রাখার প্রবণতাকে হ্রাস করবে।
ভ্যাক্সিনের কার্যকারিতা যাচাইয়ের হালনাগাদ
Phase-3 এর পরবর্তী পদক্ষেপ অনুযায়ী ৩০,০০০ – ৪০,০০০ মানুষের উপর ভ্যাক্সিনের ট্রায়াল দেয়া হবে। এদের মধ্যে কিছু মানুষকে ‘প্লাসিবো’ দেয়া হবে এবং তাদের ইনফেকশনের হারের সাথে ভ্যাক্সিন প্রাপ্তদের ইনফেকশনের হারের তুলনা করে, তার ভিত্তিতে Phase-3 এর চূড়ান্ত ফলাফল ঘোষণা করা হবে।
শেষ কথা
আশা করা হচ্ছে যে, ২০২০ সালের ইতি টানার পূর্বেই FDA কর্তৃক একাধিক কোভিড ভ্যাক্সিন অনুমোদন পাবে। বয়স্ক ও স্বাস্থ্যগতভাবে অধিক ঝুঁকিপূর্ণ যারা, তারা এক্ষেত্রে অগ্রাধিকার পাবে। তবে অবশ্যই ভ্যাক্সিন প্রাপ্ত সকলকেই পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া পর্যবেক্ষণের জন্য FDA ও ভ্যাক্সিন উৎপাদনকারী গবেষকদের তত্ত্বাবধানে থাকার পরামর্শ দেয়া হচ্ছে। এভাবে ভ্যাক্সিনের পরবর্তীকালীন উন্নয়ন সাধন করাও সহজ হবে। কিন্তু, ২০২১ সালে সবকিছু স্বাভাবিক হবে কিনা এই ব্যাপারে সম্পূর্ণ আশ্বাস দেয়া যাচ্ছে না এখনি। স্বাভাবিক না হলেও এটি অস্বীকার করার নয় যে, ২০২১ সাল কিছুটা হলেও সুসংবাদ বয়ে আনবে।
দারিমি হাসিন
জিন প্রকৌশল ও জীবপ্রযুক্তি বিভাগ,
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট।
তথ্যসূত্রঃ