এক নজরে বায়োসেফটি

ঘটনা-১
জুন, ২০১৪ – যুক্তরাষ্ট্রের এক ল্যাবরেটরিতে অ্যানথ্রাক্স এর উপর গবেষণা করার সময় ৪১ জন কর্মী অ্যানথ্রাক্স এর জীবাণু দ্বারা আক্রান্ত হন। (অ্যানথ্রাক্স এক ধরনের সংক্রামক রোগ যা Bacillus anthracis নামক ব্যাকটেরিয়ার কারণে হয়ে থাকে।)
ঘটনা-২
এপ্রিল, ২০১১ – শেই স্যাংজি, একজন ল্যাবরেটরি কর্মী Tert-butyllithium নিয়ে কাজ করতে থাকেন। দূর্ঘটনাবশত এর কিছু অংশ তার হাতে এবং কাপড়ে লেগে যায়। উল্লেখ্য, তিনি ল্যাব কোট পরিহিত অবস্থায় ছিলেন না। এর ফলে তার দেহের ৪০ শতাংশ এরও বেশী পুড়ে যায় এবং এ ঘটনার ২-৩ সপ্তাহের মধ্যে তিনি মারা যান। (Tert-butyllithium এক ধরনের রাসায়নিক যৌগ যা বাতাসের সংস্পর্শে জ্বলে ওঠে।)
ঘটনা-৩
আগস্ট, ১৯৬৭ – জার্মানিতে ৩১ জন ল্যাব কর্মী মারবার্গ ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হন এবং এদের মধ্যে ৭ জন মারাও যান। (মারবার্গ ভাইরাসের আক্রমণে উচ্চ তাপমাত্রার জ্বর এবং রক্তক্ষরণ হয় যার ফলে শরীরের কোনো অঙ্গ বিকল হয়ে মৃত্যু হতে পারে।)
এরকম আরো অনেক ঘটনা আছে যেখানে ল্যাবরেটরি কর্মীরা প্রাণঘাতী বায়োহ্যাজার্ড নিয়ে কাজ করার সময় এরই মারাত্নক আক্রমণের শিকার হন। বায়োহ্যাজার্ড হল বিভিন্ন ধরনের বিষাক্ত অণুজীব বা বস্তু যা মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য হুমকিস্বরূপ। আর এসকল বায়োহ্যাজার্ড নিয়ে কাজ করার সময় দরকার বায়োসেফটি।
বায়োসেফটি হল নিরাপত্তামূলক ব্যাবস্থা যা ল্যাবরেটরি কর্মীদের মরণঘাতী অণুজীব বা রাসায়নিক যৌগ এর সংস্পর্শে আসা থেকে রক্ষা করে। একজন গবেষক ল্যাবরেটরিতে প্রায় প্রতিদিনই প্যাথোজেন বা বিষাক্ত অণুজীব নিয়ে কাজ করে থাকেন। আর তার নিজের সুরক্ষা সেই সাথে তার সহকর্মীদের এবং লাবরেটরি পরিবেশের সুরক্ষার জন্য কিছু পদক্ষেপ নিতে হয়। মূলত এটিই হল বায়োসেফটি। এ বায়োসেফটি নির্ভর করে কি ধরনের বায়োহ্যাজার্ড নিয়ে কাজ করা হয় তার উপর।
একজন ভাইরোলজিস্ট কাজ করেন ভাইরাস এর স্যাম্পল নিয়ে, মাইক্রোবায়োলজিস্ট কাজ করেন ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়াসহ বিভিন্ন ধরনের অণুজীব নিয়ে, বায়োটেকনলজিস্ট কাজ করেন অণুজীবের ডিএনএ, আরএনএ নিয়ে। এরকম রয়েছে আরো অনেক ক্ষেত্র। এসব দিক বিবেচনা করে সিডিসি (CDC: Centers for Disease Control & Prevention) কর্তৃক বায়োসেফটি লেভেলকে ৪ ভাগে ভাগ করা হয়েছে- বায়োসেফটি লেভেল-১, বায়োসেফটি লেভেল-২, বায়োসেফটি লেভেল-৩, বায়োসেফটি লেভেল-৪
বায়োসেফটি লেভেল-১ (BSL-1)
যেসকল অণুজীব সংক্রামক নয় সেসকল অণুজীব নিয়ে এখানে কাজ করা হয়। যেমনঃ E. coli এর নন-প্যাথোজেনিক স্ট্রেইন নিয়ে এ ধরনের ল্যাব এ কাজ করা হয়।
এক্ষেত্রে ল্যাব এ যে ধরনের সচেতনতার প্রয়োজন হয়ঃ
i. হাত জীবাণুমুক্ত করে নেওয়া।
ii. ল্যাব এ খাবার, কোমল পানীয় না রাখা এবং ধূমপান না করা।
iii. জীবাণুমুক্ত জায়গা বা বেঞ্চিতে কাজ করা।
iv. কাজ শেষ হওয়ার পর সব যন্ত্রপাতি পরিষ্কার করে রাখা।
বায়োসেফটি লেভেল-২ (BSL-2)
এক্ষেত্রে বায়োহ্যাজার্ডগুলো ল্যাব কর্মীদের জন্য কিছুটা হুমকিস্বরূপ। সাধারণত দূর্ঘটনাবশত এগুলো ত্বক, নিঃশ্বাস এবং ইনজেকশনের মাধ্যমে শরীরে প্রবেশ করে থাকে।
এই ল্যাবরেটরিতে কাজ করার সময় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো হলঃ
i. পিপিই পরিধান করা যার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে ফেইস শিল্ড, গগলস, গ্লাভস, ফেস মাস্ক প্রভৃতি।
ii. বায়োসেফটি কেবিনেট এ কাজ করা।
iii. যখন কাজ করা হয় তখন ল্যাবে প্রবেশ নিষিদ্ধ করা।
বর্তমানে করোনা ভাইরাস নিয়ে কাজ করার জন্য এ লেভেলের ল্যাবরেটরিগুলো ব্যবহার করা হচ্ছে।
বায়োসেফটি লেভেল-৩ (BSL-3)
অত্যন্ত বিপদজনক বায়োহ্যাজার্ডগুলো নিয়ে এখানে কাজ করা হয়। যেমনঃ ম্যালেরিয়া, অ্যানথ্রাক্স, সারস ভাইরাস, মারস ভাইরাস।
এ লেভেল এর ল্যাবরেটরিতে কাজ করার জন্য পদক্ষেপগুলোঃ
i. বাইরের বাতাস যেন ভিতরে প্রবেশ না করে।
ii. পিপিই পরিধান করা এবং সাথে অবশ্যই রেস্পিরেটরি মেডিকেল মাস্ক ব্যবহার করা।
iii. বায়োসেফটি কেবিনেট ব্যবহার করা।
iv. ল্যাব এ নিয়ন্ত্রিত আসা-যাওয়া করা।
বায়োসেফটি লেভেল-৪ (BSL-4)
এটি বায়োসেফটির লেভেল এর সর্বোচ্চ স্তর। মরণঘাতী বায়োহ্যাজার্ডগুলো নিয়ে এখানে কাজ করা হয়। যেমনঃ ইবোলা ভাইরাস, মারবার্গ ভাইরাস। এক্ষেত্রে ল্যাব এ যে ধরনের সচেতনতার প্রয়োজন হয়ঃ
i. ল্যাব এ প্রবেশ করার পূর্বে কাপড় পরিবর্তন করা এবং বের হওয়ার পরে গোসল করে নেওয়া।
ii. আলাদা ভবনে ল্যাব স্থাপন করা।
iii. বায়োসেফটি কেবিনেট এ কাজ করা।
iv. ল্যাব থেকে বের হওয়ার পূর্বে সব যন্ত্রপাতি জীবাণুমুক্ত করে রাখা।
প্রকৃতপক্ষে, নতুন কিছু আবিষ্কারের নেশায়, মানবজাতির নিরাপত্তা ও আরামের জন্য প্রতিনিয়ত কাজ করে যাচ্ছেন এ ল্যাবরেটরিয়ান যোদ্ধারা। সেই সাথে তাদের এবং পরিবেশের সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্যই প্রয়োজন বায়োসেফটি।
- সাদিয়া জামান
জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড বায়োটেকনলজি
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা-১১০০
তথ্যসূত্রঃ
1. https://consteril.com/biosafety-levels-difference/
2. https://www.niaid.nih.gov/research/biosafety-labs-needed
3. https://www.nature.com/news/biological-research-rethink-biosafety-1.18747
4. https://cen.acs.org/safety/lab-safety/10-years-Sheri-Sangjis-death/97/i1