‘ব্যাকটেরিয়া’- মস্তিষ্কে কতটা প্রভাব ফেলে

আমরা আক্ষরিক অর্থেই ক্ষুদে অনুজীবদের সাগরে বসবাস করি। চারপাশে ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস, সব জায়গায়, সব সময় আমাদের ঘিরে রেখেছে। আমরা প্রতিনিয়ত ব্যাকটেরিয়া ধরছি, খাচ্ছি। আমাদের দেহে পেলে-পুষে বড় করছি। আমাদের শরীরের ভিতরে বাহিরে গিজগিজ করছে এই সমস্ত অনুজীব। শুনে হয়তো অবাক হবেন, আমাদের দেহে যতটা মানব কোষ আছে, তার চেয়ে বেশি আছে ব্যকটেরিয়াল কোষ। অনুপাতটা ১.৩ঃ১ এর মত। মানে হচ্ছে, আপনার দেহটা শুধু আপনার দেহ নয়। ক্যালিফোর্নিয়া স্যান ডিয়াগো ইউনিভার্সিটির প্রফেসর রব নাইটের ভাষায়- আমরা যতটা না মানুষ, তার চেয়ে বেশি অনুজীব!
এইসব ব্যাকটেরিয়ার কথা শুনলেই আমাদের মাথায় আসে হাজার হাজার রোগ-শোকের কথা। কিন্তু সত্যি যদি সব ব্যাকটেরিয়াই রোগ তৈরি করত, বুঝতেই পারছেন, আমাদের আর বেঁচে থাকতে হত না। আমাদের দেহে যত ব্যাকটেরিয়া থাকে, তার বেশিরভাগই কোনো রোগ তৈরি করেনা। বরং নানাভাবে কাজে আসে। আমরা ব্যাকটেরিয়ার সাথে সুন্দর সহযোগিতার একটা সম্পর্ক তৈরি করে নিয়েছি।
এরা আমাদের দেহের অংশ। এই ব্যাকটেরিয়াদের কাজ কর্ম আমাদের ওপর বিড়াট প্রভাব ফেলে, অনেক কিছুই নিয়ন্ত্রণ করে। আমাদের নিজেদের জানার জন্যই শরীরের ব্যাকটেরিয়াগুলো সম্পর্কে ভালভাবে জানা জরুরি।
আজ মানব স্বাস্থ্যের ওপর ব্যাকটেরিয়ার প্রভাবের দু-একটা উদারহণ দেখার চেষ্টা করব।
২০০৬ সালে কানাডার টরেন্টোর ম্যাকমাস্টার ইউনিভার্সিটির নিউরোসায়েন্টিস্ট জেন ফস্টার একটা গবেষণা করেছিলেন। গবেষণাটি ছিল ইদুঁরের ওপর। ফস্টার দুই রকমের ইদুর নিয়েছিলেন। এক গ্রুপের ইদুর সুস্থ, স্বাভাবিক। অন্ত্রে স্বাভাবিক ব্যাকটেরিয়া আছে। অন্য গ্রুপের ইদুরের অন্ত্রের ব্যাকটেরিয়া সরিয়ে নেয়া হয়েছে। দুই গ্রপের ইদুরের আচরণ লক্ষ্য করে দেখা গেল তারা ভিন্ন আচরণ করছে। কম আন্ত্রিক ব্যাকটেরিয়া বিশিষ্ট ইদুর অন্য ইদুর থেকে কম উদ্বিগ্ন থাকছে। খোলা রাস্তা ও ওয়াল দিয়ে তৈরি পাজলে ছেড়ে দিলে তারা ভিন্ন রকম আচরণ করছে। এর থেকে সিদ্ধান্তে আসা গেল যে অন্ত্রের ব্যাকটেরিয়া প্রাণীর আচরণে ভূমিকা রাখে, মস্তিষ্কে প্রভাব ফেলে। জেন ফস্টার তার গবেষণাপত্র সাত বার সাবমিট করার পর অ্যাকসেপ্টেন্স লেটার পান। এখন এই আন্ত্রিক ব্যাকটেরিয়ার সাথে মস্তিষ্কের সম্পর্কের বিষয়টা নিউরো সায়েন্সে সাধারণভাবে গৃহীত এবং অনেক গবেষণা ও পেপার রয়েছে এর ওপর।
সাধারণভাবে চিন্তা করলে ব্যাপারটা অসাধারণ। আমাদের দেহে বাস করা কিছু ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অনুজীব আমাদের আচরণকে পরিবর্তন করছে, মস্তিষ্কের পরিবর্তন আনছে। তাই না?
আবার ব্যাকটেরিয়াগুলো বাস করে অন্ত্রে। মস্তিষ্ক থেকে অনেক দূরে। এদের মাঝে সহজ কোনো যোগসূত্রও নেই। এই পুরো প্রক্রিয়াটা ঘটছে কিভাবে?
ইদানিং কালের গনেষণাগুলো এই ব্যাপারে আলো ফেলেছে। মানুষের পর্কিনসন নামের মস্তিষ্কের একটি রোগ আছে। এই রোগে রোগীর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের নাড়াচাড়ায় সমস্যা হয়। কিছু গবেষক দাবি করেছেন যে এই রোগের সূচনাটা আসলে হয় অন্ত্র থেকে।
এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির লক্ষণ হচ্ছে খিচুনি, অঙ্গের অনিয়ন্ত্রিত কম্পন, নড়াচড়া ধীর হয়ে যাওয়া ইত্যাদি। মস্তিষ্কের সমন্বয়ের জন্য দায়ী নিউরন গুলো মারা যাওয়ার ফলে এই রোগ হয়। ঠিক কি কারণে নিউরণ মারা যায় তা জানা না গেলেও Alpha- synclein নামের একটি প্রোটিন পাওয়া গেছে যেটি এই কাজে প্রধান ভূমিকা রাখে। পার্কিনসন আক্রান্ত সকল রোগীর মস্তিষ্কে এই প্রোটিনটি মিসফোল্ডেড অবস্থায় পাওয়া যায়। একটি প্রোটিন মিসফোল্ড হলে সেটি আরও প্রোটিনকে মিসফোল্ড করতে থাকে এবং একটা পিন্ড গঠন করে। একে lewy bodies বলা হয়। গবেষকেরা অন্ত্রে এমন ব্যাকটেরিয়া খুজে পেয়েছেন যেটি মিসফোল্ডেড alpha-synclein এর মত স্ট্রাকচার বিশিষ্ট প্রোটিন উৎপন্ন করে। এই কো-ইনসিডেন্স দেখে বিজ্ঞানীরা ধারণা করলেন হয়তো এই ব্যাকটেরিয়াল প্রোটিনটি ট্রিগার হিসেবে কাজ করে। সুতারং ব্যপারটা পরীক্ষা করা হল। ই. কোলাই ব্যকটেরিয়ার একটা স্ট্রেইন যেটি সেরকম প্রোটিন উৎপন্ন করে, সেটি ইদুরকে খাইয়ে দেওয়া হল। এবং দেখা গেল ইদুর গুলোর মস্তিষ্কে alpha-synclein এর পরিমাণ স্বাভাবিকের চাইতে অনেক বেশি হয়ে গেছে। অর্থাৎ অন্ত্রের ব্যাকটেরিয়ার প্রোটিন মস্তিষ্কে alpha-synclein সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখছে। এখন প্রশ্নটা হল এই সিগন্যালটা মস্তিষ্কে পৌছে কিভাবে?
এখানে সবচেয়ে সম্ভাব্য পথটা হল ভেগাস নার্ভ। বারোটা ক্রেনিয়াল নার্ভের মাঝে সবচেয়ে বড় এটি, মস্তিষ্কের সাথে দেহের বাকি অংশের সংযোগ রক্ষা করে। তো গবেষকরা আবার ইঁদুরের অন্ত্রে সেই আলফা-সিনক্লেইন প্রোটিনটি ইনজেক্ট করলেন। কিন্তু এবার আগে থেকে তারা সেই ইঁদুরের ভেগাস নার্ভ কেটে দিয়েছিলেন। দেখা গেল মস্তিষ্কে কোনো মিসফোল্ডেড প্রোটিন নেই। অর্থাৎ ভেগাস নার্ভই অন্ত্র ও মস্তিষ্কের যোগসূত্র।
জন হপকিন্সের নিউরোসায়েন্টিস্ট ভ্যালিনা ডওসন বলছেন এখনে সম্ভবত ডোমিনো ইফেক্ট কাজ করছে। মিসফোল্ডেড প্রোটিন তাদের ভুলগুলো ভেগাস নালীর মাধ্যমে মস্তিষ্কে পাঠাতে থাকে যতক্ষণ পর্যন্ত না সেই মিসফোল্ডেড প্রোটিন মস্তিষ্কে তৈরি হয়।
এই মিসফোল্ডেড প্রোটিন শুধু পর্কিনসন নয়, অ্যালঝেইমার, মোটর নিউরন ডিজিজের মত মস্তিষ্কের রোগ গুলোরও হলমার্ক। আর মজার ব্যাপার হল এসব ক্ষেত্রেও ব্যাকটেরিয়াল প্রোটিনের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা দেখা গেছে।
মোটর নিউরন ডিজিজ ( ALS) এ আক্রান্ত রোগীদের পর্যবেক্ষণ করে দেখা যায় কেরো ক্ষেত্রে ধীরে ধীরে অসুস্থতা বৃদ্ধি পাচ্ছে, করো ক্ষেত্রে দ্রুত। এটা নিয়ে কাজ করছিলেন রৈবুতের ওয়াইজম্যান ইন্সটিটিউট অব সায়েন্সের ইমিউনোলজিস্ট ইরান এলিনাভ। তিনি আশ্চর্য হয়েছিলেন যখন এর কারণ খুজে পেলেন অন্ত্রের ব্যাকটেরিয়ার মাঝে। তার দল কাজ করছিল ALS এর সবচেয়ে কমন ইঁদুরের মডেল নিয়ে। দেখা গেল যেসব ইঁদুরের জন্ম থেকে আন্ত্রিক ব্যাকটেরিয়া কম বা যাদের ব্যাকটেরিয়া অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে মেরে ফেলা হয়েছে তাদের ক্ষেত্রে স্বাভাবিক ব্যাকটেরিয়ার তুলনায় রোগ খুব তাড়াতাড়ি বৃদ্ধি পাচ্ছে। দুই ধরনের স্যাম্পল থেকে খুজে-পেতে কয়েক প্রজাতির ব্যাকটেরিয়া পাওয়া গেল যারা রোগের ওপর প্রভাব বিস্তার করে। তার মধ্যে দুটো প্রজাতি রোগটাকে আরো খারাপ করে তোলে এবং একটা প্রজাতি রোগীর উন্নতি করতে সাহায্য করে। এগুলো মূলত ব্যাকটেরিয়ার মেটাবলিজমে সৃষ্ট বিভিন্ন অনুর কারণে হয়। আমাদের উপকারী ব্যাকটেরিয়া প্রজাতির মেটাবলিজমে সৃষ্ট অনুটি হল নিকোটিনামইড- যাকে আমরা ভিটামিন-বি৩ নামে চিনি। এর ওপর বড় আকারে কোনো মেডিক্যাল ট্রায়াল হয়নি। তবে ছোট আকারে চার মাসের একটি ট্রায়াল হয়েছে।
সেখানে ALS আক্রান্ত একটি গ্রপের ওপর ভিটামিন-বি৩ প্রয়োগে অধিকাংশ ক্ষেত্রে পজিটিভ ফলাফল এসেছে এবং বেশিরভাগ প্লাসিবো ব্যার্থ হয়েছে।
মানব দেহে মোট জিনের সংখ্যা ২০ হাজার যেখানে আমাদের দেহে বাস করা ব্যাকটেরিয়াদের মোট জিন সংখ্যা ২০ মিলিয়নের অধিক। ফলে এখানে কাজের বিড়াট ক্ষেত্র উন্মুক্ত হয়ে আছে। এবং আমরা হয়তো অদূর ভবিষ্যতে এই বিষয়ে আরো চমৎকার সব তথ্য পাবো।
নিবির রহমান
জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড বায়োটেকনোলজি
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
সোর্সঃ