ধরুন, আপনার প্রচণ্ড মাথাব্যথা, নানা ব্যস্ততায় সকালের নাস্তাটা করা হয়ে উঠে নি। দেরি করে যখন খাবারটা খেলেন, মাথাব্যথা একটু পর নিমিষেই চলে গেল। এমন ঘটনার সম্মুখীন হয় নি এমন খুব কম মানুষই পাওয়া যাবে। কিন্তু কেন এমন ঘটে? 

এটি ঘটে মূলত খাদ্য এবং মস্তিষ্কের পারস্পরিক যে সম্পর্ক রয়েছে তার কারণে।

আশ্চর্যজনক হলেও সত্যি মস্তিষ্কের ওজন মাত্র তিন পাউন্ড কিন্তু এটি দেহের সমস্ত জৈবিক কাজ পরিচালনায়,বাহ্যিক পরিবেশের সাথে সম্পর্ক স্থাপনে এবং মন ও আত্নাকে একীভূতকরণে অংশ নিয়ে থাকে। বুদ্ধিমত্তা, সৃজনশীলতা, আবেগ, স্মৃতি, চলাফেরা, শ্বসন এবং হৃদস্পন্দন; মূলত সকল শারীরবৃত্তীয় কাজ মস্তিষ্ক দ্বারা নিয়ন্ত্রিত, এটি ২৪/৭ সময় কাজ করে এমনকি আমরা যখন ঘুমিয়ে থাকি তখনও। এ সমস্ত কাজ পরিচালনার জন্য মস্তিষ্কের প্রয়োজন শক্তির, যার মূল উৎস খাদ্য। তবে খাদ্যের বিভিন্নতা আমাদের মস্তিষ্কের কাঠামো, কর্মদক্ষতা ও কখনো মানসিক অবস্থারও তারতম্য ঘটায়। 

ব্যয়বহুল গাড়ি চালাতে যেমন উন্নতমানের জ্বালানী দরকার, তেমনি মস্তিষ্ক পরিচালনার জন্য জ্বালানী রূপে উন্নতমানের খাদ্য প্রয়োজন। এ সকল খাদ্যে রয়েছে ভিটামিন, মিনারেল এবং অ্যান্টিঅক্সিড্যান্ট, যা  মস্তিষ্ককে পুষ্টি জোগায় এবং অক্সিডেটিভ স্ট্রেস থেকে রক্ষা করে। 


দুর্ভাগ্যক্রমে, প্রক্রিয়াজাত ও পরিশোধিত খাদ্য গ্রহণের ফলে মস্তিষ্ক সঠিকভাবে কাজ করতে পারে না, কারণ এসব দূষণ থেকে পরিত্রাণ পাওয়া মস্তিষ্কের পক্ষে সম্ভব নয়। যেমন অতিরিক্ত চিনি গ্রহণে মস্তিষ্কে প্রভাব পড়ে। এছাড়াও দেহের ইনসুলিন নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা কমে যায়, যা প্রদাহ এবং অক্সিডেটিভ স্ট্রেস বৃদ্ধি করে; গত ২৫ বছরে ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা ১০৮ মিলিয়ন  থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪২২ মিলিয়ন। বর্তমানে বেশিরভাগ মানুষ বিষণ্নতায় ভোগার অন্যতম কারণের মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি কারণ প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় অতিরিক্ত চিনি গ্রহণ।

এ থেকে এটা বোঝা যায় যে,মস্তিষ্ক যদি ভাল মানের পুষ্টি থেকে বঞ্চিত হয়, কিংবা ক্ষতিকারক ও প্রদাহ সৃষ্টিকারী খাদ্য বেশি পায়, তাহলে পরবর্তীতে মস্তিষ্কের টিস্যুর ক্ষতি সাধন করে। তবে মজার ব্যাপার হচ্ছে, চিকিৎসাবিজ্ঞান বহুবছর মানসিক অবস্থা ও খাদ্যের সম্পর্ক সম্বন্ধে অজ্ঞাত ছিল। 

 

একজন স্নায়ুবিজ্ঞানী ৭ টি খাদ্য আপনার প্রতিদিনের খাদ্যাভাসে অন্তর্ভূক্ত করতে জোর দিয়েছেন তা হল:

 

১। ফ্যাটি এসিডদসমৃদ্ধ মাছ

এতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ওমেগা-3, যা মস্তিষ্কের প্রাত্যহিক কাজে অত্যন্ত প্রয়োজন। একজন প্রাপ্ত বয়স্ক মহিলার দৈনিক ১.১ গ্রাম ওমেগা-3 প্রয়োজন। তিন আউন্স বন্য সালমনে ১.৫৯ গ্রাম ওমেগা-3 থাকে। তাছাড়া মাছের তেলেও প্রচুর পরিমাণে ওমেগা-3 রয়েছে।

২। সবুজ শাক-সবজি

সবুজ শাক-সবজি যেমন: পালং শাক, পুঁইশাক, ফুলকপি, বাঁধাকপি, সিম, বরবটি ইত্যাদি  মস্তিষ্কের জন্য় উপকারি। এতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন, মিনারেল, ফাইবার ও রোগ-প্রতিরোধী উপাদান; যা স্বাস্থ্যকর স্নায়ুতন্ত্র গঠনে সহায়ক।

৩। এক্সট্রা ভার্জিন জলপাই তেল এবং তিসি তেল

এ সকল তেলে প্রচুর পরিমাণে ওমেগা-3 এবং ভিটামিন ই থাকে। এক্সট্রা ভার্জিন জলপাই তেল মনস্যাচুরেটেড ফ্যাট সমৃদ্ধ, যা মন ও মস্তিষ্কের জন্য দরকারি। 

৪। কোকোয়া

মস্তিষ্কের কর্মক্ষমতা বৃদ্ধিতে চকলেটের ভূমিকা উল্লেখযোগ্য; এটি হৃদরোগ ও ডায়াবেটিস রোগের সম্ভাবনা কমায়। 

৫। জটিল শর্করা

শস্য, মটরশুটি, শিম, বেরি এবং মিষ্টি আলু ইত্যাদি জটিল শর্করার শ্রেষ্ঠ উৎস। এ সকল খাদ্য়ে প্রচুর পরিমাণে  শর্করা রয়েছে, যা মস্তিষ্কের শক্তির উৎস এবং ইনসুলিনের ভারসাম্য বজায় রাখে।

৬। ফলমূল

ফলমূল অ্যান্টিঅক্সিডেন্টে পূর্ণ, যা মেধা বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। এটি ফাইবার ও গ্লুকোজের অন্যতম উৎস। এসব ফল অনেক মিষ্টি হওয়া স্বত্ত্বেও খুব অল্প গ্লাইসেমিক ইন্ডেক্স থাকে, যা রক্তের গ্লুকোজকে নিয়ন্ত্রণ করে।

৭। পানি

মস্তিষ্কের অবকাঠামো গঠনে পানির ভূমিকা অপরিসীম। এটি কোষের শূন্যস্থান পূরণে সহায়তা করে; প্রোটিন গঠনে সাহায্য করে, খাদ্য উপাদান ও দূষক পদার্থ শোষণ করে। এমনকি দেহে পানি শূন্যতার ফলে দেহের ওজন ২-৪% ওজন হ্রাস, মস্তিষ্কের ভারসাম্যহীনতা, বিলম্বিত প্রতিক্রিয়া, মাথাব্যথা ও মেজাজ পরিবর্তন দেখা দেয়।

বর্তমানে ভাগ্যক্রমে, পুষ্টি মনোরোগবিদ্যার ক্রমবর্ধমান বৃদ্ধির ফলে অনুধাবন করতে পেরেছি , আসলে আমরা যা খাই, যা অনুভব করি, যেভাবে আচরণ করি এমনকি আমাদের অন্ত্রে যে ব্যাকটেরিয়া থাকে তাদের প্রত্যেকের গুরুত্ব ও পারস্পরিক সম্পর্ক রয়েছে। তাই খাদ্য তালিকার প্রতি যত্নবান হোন। খাবার আগে ভাবুন, কারণ খাদ্যাভ্যাস সঠিক না হলে পরবর্তীতে চিন্তার শক্তিই কিন্তু পাবেন না।

 

ফারহা আনিকা 

এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স 

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়

 

তথ্যসূত্র: