ফাইটোরেমিডিয়েশনঃ পরিবেশ রক্ষায় গাছের অনবদ্য এক উদাহরণ

ভেবে দেখুন তো সবুজ উদ্ভিদ যদি আপনার আশেপাশের মাটি,পানি এমনকি বায়ুতে থাকা ক্ষতিকর আবর্জনা দূর করে দেয় তবে কেমন হবে! হ্যা,তাই করে থাকে কতিপয় সবুজ উদ্ভিদ। বিশেষ এ প্রক্রিয়ায় সবুজ উদ্ভিদ যখন তার আশেপাশের মাটি,পানি কিংবা বায়ুতে থাকা আবর্জনা নিঃশেষ করে ফেলে বা বিদ্যমান ক্ষতিকারক পদার্থকে অক্ষতিকারক পদার্থে রূপান্তরিত করে তখনি একে বলা হয় ফাইটোরেমিডিয়েশন। একেক প্রজাতির উদ্ভিদের দূষণ কমানোর ধরন,দূষিত পদার্থ ধ্বংস বা রূপান্তরের ধরন এবং দূষিত পদার্থ নিঃশেষ করার ক্ষমতা একেক রকম। আমাদের আশেপাশেই হয়তো এমন উদ্ভিদ রয়েছে যাদের ফাইটোরেমিডিয়েশন পাওয়ার সম্পর্কে আমাদের ধারণা নেই। হয়তো এসব উদ্ভিদগুলোকে আমরা কাজে লাগাতে পারতাম আমাদের পরিবেশে বিদ্যমান অসংখ্য দূষণের পরিমাণ কিছুটা হলেও কমিয়ে আনতে।
পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় ফাইটোরেমিডিয়েশন এর জুড়ি নেই। বিভিন্ন ধরনের দূষণ কমাতে পরিবেশবিদরা ফাইটোরেমিডিয়েশন নিয়ে প্রতিনিয়ত নানাধরনের পরীক্ষা করে যাচ্ছে। এখন পর্যন্ত অনেক প্রজাতির উদ্ভিদের ফাইটোরেমিডিয়েশন পাওয়ার জানা গেছে এবং কার্যকরী উপায়ে ব্যবহার করা হচ্ছে বিভিন্ন দূষিত স্থানে।
চলুন জেনে নেয়া যাক কি কি উপায়ে উদ্ভিদ ফাইটোরেমিডিয়েশনের মাধ্যমে আমাদের পরিবেশকে রক্ষা করে চলেছে বিভিন্ন দূষণের হাত থেকে।
ফাইটো স্ট্যাবিলাইজেশন: উদ্ভিদ এ প্রক্রিয়ায় যে ধরনের দূষিত পদার্থগুলোকে ধ্বংস বা রূপান্তর সম্ভব নয় সেগুলোকে ইমমোবিলাইজ করে।
ফাইটো এক্সট্রাকশন: বিশেষ এ প্রক্রিয়ায় উদ্ভিদ পানি এবং নিউট্রিশনের সাথে দূষিত পদার্থগুলোকে শোষণ করে নেয়। এসব পদার্থগুলোর রূপান্তর সম্ভব না হলে কান্ড এবং পাতায় উদ্ভিদ তা ধারণ করে থাকে। পানিতে দ্রবীভূত বেশ কিছু ক্ষতিকারক ধাতব দূষিত পদার্থ(ক্যাডমিয়াম,নিকেল,জিংক,আর্সেনিক,সেলেনিয়াম,কপার,কোবাল্ট,ম্যাঙ্গানিজ,আয়রন) নিরসনে ফাইটো এক্সট্রাকশন দারুণভাবে কার্যকরী।
রাইজোস্ফিয়ার বায়োডিগ্রেডেশন: উদ্ভিদ সরাসরি কাজ না করে কিছু soil bacteria কে নিউট্রিশন দিয়ে শক্তি জোগায় এবং সেগুলো পরবর্তীতে মাটিতে থাকা দূষিত পদার্থকে ভেঙ্গে মাটিকে দূষণমুক্ত করে। উদ্ভিদ তার মূলের সাহায্যে স্টিমুলেটর হিসেবে রাসায়নিক পদার্থগুলো সরবরাহ করে থাকে রাইজোস্ফিয়ার বায়োডিগ্রেডেশনে কাজ করা ব্যাকটেরিয়াগুলোকে।
রাইজোফিলট্রেশন: এ প্রক্রিয়াটি কিছুটা ফাইটোএক্সট্রাকশন প্রক্রিয়ার মতো হলেও ব্যবহৃত উদ্ভিদগুলোকে বড় করা হয় গ্রীনহাউজ এর মধ্যে এবং তাদের মূল থাকে পানিতে ডুবানো। গ্রাউন্ডওয়াটার ট্রিটমেন্ট এর জন্য রাইজোফিলট্রেশন উপযোগী এক প্রক্রিয়া।
ফাইটো ভোলেটিলাইজেশন: অভিনব এ প্রক্রিয়ায় উদ্ভিদ পানির সাথে মিশে থাকা দূষিত পদার্থগুলোকে শোষণ করে এবং পাতার সাহায্যে এগুলোকে বাতাসে ছেড়ে দেয়।
ফাইটো ডিগ্রেডেশন: উদ্ভিদ নিজেদের টিস্যুর ভেতর বিপাকীয় প্রক্রিয়ার সাহায্য নিয়ে পরিবেশের দূষিত পদার্থগুলোকে ধ্বংস করে ফেলে যেটি ফাইটো ডিগ্রেডেশন নামে পরিচিত।
উল্লেখিত প্রক্রিয়াগুলো ছাড়াও উদ্ভিদের জানা- অজানা আরো বেশ কিছু ফাইটোরেমিডিয়েশন প্রক্রিয়া বিদ্যমান যা প্রতিনিয়ত আমাদের পরিবেশের দূষণ কমাতে সাহায্য করে যাচ্ছে।
এবার ফাইটোরেমিডিয়েশনের কিছু প্রয়োগ তুলে ধরছি যা থেকে আরো বিস্তর ধারণা পেতে সুবিধা হবে।
★রাশিয়ার চেরনোবিল ট্র্যাজেডির কথা কমবেশি সবাই জানি। সেখানকার পুকুরে Sunflower ব্যবহার করে রাইজোফিলট্রেশন প্রক্রিয়ায় সফলভাবে তেজস্ক্রিয় পদার্থ দূরীকরণ সম্ভব হয়েছে।
★যুক্তরাষ্ট্রের অরেগন অঙ্গরাজ্যে Populus tricbocarpa deltoides উদ্ভিদ ব্যবহার করা হচ্ছে wastewater treatment এর কাজে।
★যুক্তরাষ্ট্রের ওহাইও অঙ্গরাজ্যে রেডিওনিউক্লাইড দূষিত মাটি এবং পানি দূষণমুক্ত করতে ফাইটোএক্সট্রাকশন প্রক্রিয়ার ব্যবহার হয়ে আসছে যার মাধ্যমে মাটি থেকে ইউরেনিয়াম দূর করা যাচ্ছে। তারা Hybrid poplar ব্যবহার করে ৯৭% ট্রাইক্লোরোইথাইলিন এবং Black locust ব্যবহার করে ৯৫% টেট্রাক্লোরাইড দূরীকরণে সফল হয়েছে।
★এছাড়াও US Environmental Protection Agency ঘোষণা করে যে, poplar tree মাটির নিচের পানি থেকে দূষিত হার্বিসাইড,পেস্টিসাইড এবং সার দূর করতে সক্ষম।
★আমেরিকান সেনাবাহিনী wetland plant ব্যবহার করে মাটি এবং মাটির নিচের জমাকৃত পানি থেকে বিস্ফোরক দ্রব্য দূর করার পরীক্ষা করে উল্লেখযোগ্য ফলাফল পায়।
দেখা যায় যে, Coontail,Pondweed, Arrowhead উদ্ভিদগুলো ৫% TNT দূর করতে সফল হয়। অন্যদিকে প্রায় ৪০% RDX দূর করা সম্ভব হয় Coontail, Pondweed উদ্ভিদ প্রয়োগ করে।
তবে ফাইটোরেমিডিয়েশনের ক্ষেত্রে কিছু জিনিস জেনে রাখা ভালো। যেমন:
★উদ্ভিদের পাতায় যেসব দূষিত পদার্থ জমা থাকে সেগুলো প্রাণীদেহে ট্রান্সফার হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়।
★ স্থান এবং জলবায়ুর অবস্থা ফাইটোরেমিডিয়েশন কার্যকরী করতে বিশেষ প্রয়োজনীয়।
★কম দূষণীয় জায়গায় ফাইটোরেমিডিয়েশন তুলনামূলক কম কার্যকরী।
★দূষণের মাত্রা অত্যধিক বেশি হলে উদ্ভিদের বেঁচে থাকা অসম্ভব হয়ে পরে।
★ফাইটোরেমিডিয়েশন ভালোভাবে কাজ করার জন্য মূলত বিস্তর এলাকার প্রয়োজন।
ফাইটোরেমিডিয়েশন হতে পারে বর্তমান দূষিত পৃথিবীকে দূষণের হাত থেকে রক্ষার এক কার্যকরী উপায়। ফাইটোরেমিডিয়েশনকে আরো বিস্তরভাবে প্রয়োগ করতে হলে জানতে হবে আরো বেশি। বাড়াতে হবে গবেষণার পরিমাণ এবং সর্বোপরি ফাইটোরেমিডিয়েশন প্রক্রিয়া ব্যবহারের মাধ্যমে পরিবেশ দূষণের মাত্রা কমানোর জন্য মানুষকে অনুপ্রাণিত করতে হবে আরো বেশি বেশি।
- আয়েশা আক্তার
শিক্ষার্থী, বায়োটেকনোলজি এন্ড জেনেটিক ইন্জিনিয়ারিং বিভাগ
নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
তথ্যসূত্রঃ